মুক্ত করো ভয়, আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়

মুক্ত করো ভয়, আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়

নেত্রকোনা থেকে রনি খান

“যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ”
উত্তরে গারো পাহাড় থেকে দখিনের হাওর। ব্রহ্মপুত্রের পাড় থেকে সুরমার কোল। বৈচিত্র্যময় এই ভূগোলে সহ¯্র বছরের সমৃদ্ধ এক ঐতিহ্য তৈরি করেছে এ অঞ্চলের মানুষ। ইতিহাসের নানান পর্বে, আন্দোলন-সংগ্রামে, বিরহ-সংকটে সম্মিলনের জয়গান গেয়ে তৈরি করেছে সম্প্রীতির বিজয় আখ্যান। এ আখ্যানের পরতে পরতে লিখা আছে যুক্ততার স্মরলিপি, প্রণয়ের কালজয়ী স্লোগান। প্রাণ-প্রকৃতি-সংস্কৃতি’র সেই সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে ধারণ করেই পরবর্তীতে তৈরি হয়েছে আমাদের চলার পথ, আর সেই চলার পথেরই সাথী হয়েছেন এ প্রজন্মের কয়েকজন তরুণ। আমরা বলছি নেত্রকোনা’র কথা, বলছি নেত্রকোনা অঞ্চলের পাহাড় থেকে হাওর, নদী অঞ্চল থেকে সমতল’এ কাজ করা কিছু হার না মানা তরুণের কথা। যারা প্রাণ-প্রকৃতি-বৈচিত্র্য রক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট। একে একে মিলে যারা তৈরি করেছে বহুজনের সম্মিলন। যারা ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় এ জনপদের ঐতিহাসিক সমৃদ্ধির কালোত্তরণের সতীর্থ, সহযাত্রী। তারা কাজ করছেন বিভিন্ন বিষয়ে। কেউ প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায়, কেউ সংস্কৃতি চর্চায়, কেউ ঐতিহ্য চর্চায়, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পরিবেশ ও বৈচিত্র্যরক্ষায়, কেউ জলবায়ু ন্যায্যতায়। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দুনিয়াবাসী প্রত্যক্ষ করছে নিত্যনতুন সমস্যা। দুনিয়া এক নতুন যুগে রূপান্তরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সেই রূপান্তরের সহজাত হয়ে আসছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ।

“ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত, আমরা আনিবো রাঙা প্রভাত”
প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ সুরক্ষা, সামাজিক সম্প্রীতি সুরক্ষা, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, ঐতিহ্য চর্চা প্রভৃতি নানান বিষয়ে নেত্রকোনা জেলার বিভিন্ন উপজেলায় কাজ করে ৪৬টি যুব ও কিশোর-কিশোরী সংগঠন। তবে আজকের এই ৪৬টি সংগঠনের যাত্রা একসাথে শুরু হয়নি। কলমাকান্দা উপজেলার পাহাড়তলী চন্দ্রডিঙ্গা গ্রাম থেকে মদন উপজেলার গহীন হাওর কিংবা লোকসংস্কৃতি’র চারণভূমি কেন্দুয়া উপজেলা থেকে ব্রহ্মপুত্রের পাড় পর্যন্ত বিস্তৃত এ ‘নেটওয়ার্ক’ একদিনে গঠিত হয়নি। এমনকি এ যাত্রার সূচনা এতোটা সহজও ছিলো না। এই যাত্রায় বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা বারসিক সূচনালগ্ন থেকে এই সংগঠনগুলোর সহযাত্রী। এই যাত্রা পথে বিনিসূতোয় মালা গাঁথার মতো কাজ করেছে বারসিক। যুব সংগঠনের যুব উদ্যোগে নানাভাবেই বারসিক তার সহযোগিতার হাত অব্যাহত রেখেছে। ফলে আজকে নেত্রকোনা জেলায় দাঁড়িয়েছে ৪৬টি সংগঠনের বিশাল এক কর্মী বাহিনী। তাদের একটি একক প্লাটফর্ম ‘নেত্রকোনা সম্মিলিত যুব সমাজ’। এবং দ্ব্যার্থহীনভাবেই বলা যায় এই প্লাটফর্ম নেত্রকোনা জেলার সবচে’ বড়ো স্বেচ্ছাসেবী যুব প্লাটফর্ম।

“ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী, আমারই সোনার ধানে গিয়াছে ভরি”
চলুন মদন উপজেলা থেকে ঘুরে আসা যাক। মদন উপজেলার উচিৎপুর গ্রাম। এ গ্রামেরই মূল রাস্তা থেকে প্রাথমিক স্কুলে যাওয়ার কোন পাকা রাস্তা ছিলো না। সমস্যাটি দীর্ঘদিন যাবৎ ভুগিয়েছে গ্রামবাসীকে। মদন উপজেলা থেকে উচিৎপুর রাস্তায় ছিলো না কোন প্রাতিষ্ঠানিক বনায়ন। উচিৎপুর স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংগঠন বিষয়টিকে সবার গোচরে আনে। উন্নয়ন সংস্থা বারসিক নেয় গাছের চারা সংস্থানের দায়িত্ব। বৃক্ষরোপণের সে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন নেত্রকোনা জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক। যুব সংগঠনের নেতারা জেলা প্রশাসক মহোদয়ের প্রতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রাস্তার বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সচেষ্ট হোন। জেলা প্রশাসক মহোদয়ের ঐকান্তিক চেষ্টায় পরবর্তী এক বছরের মাথায় সে রাস্তাটি পাকাকরণ করা হয়। উচিৎপুর স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংগঠন একটি ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে। এবার চলুন যাওয়া যাক কলমাকান্দা উপজেলার চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামে। এ গ্রামে পাহাড়ি হাতির আক্রমণ, পাহাড়ি ঢল এর মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুযোর্গ তাদের নিত্যসঙ্গী। সমস্যাটি সমাধানে কাজ করতে আগ্রহী হয় গ্রামের যুবকরা। গঠন করে চন্দ্রডিঙ্গা যুব সংগঠন। বারসিক সে গ্রামে প্রায়োগিক কৃষি গবেষণা নিয়ে কাজ করছিলো আগে থেকেই। যুব সংগঠনের দাবির প্রেক্ষিতে তারা বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পর্যায় এমনকি জাতীয় পর্যায়ে বিষয়টি আলোচনায় আনেন। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক এবং টেলিভিশনের সাংবাদিকরা এ বিষয়ে সত্যনিষ্ঠ সংবাদ উপস্থাপন করেন। তারই ধারাবাহিকতায় চন্দ্রডিঙ্গা বাঁধ রক্ষা কমিটি, চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামবাসী, সরকারি এবং বেসরকারি নানা পর্যায়ের সহযোগিতায় প্রায় দেড় কিলোমিটারব্যাপী চন্দ্রডিঙ্গা ছড়াখনন এবং ছড়ার দুইপাশে বাঁধ তৈরি করে দেয়া হয়। এর ফলে আবাদের আওতায় এসেছে প্রায় ৭০০ হেক্টর জমি। চন্দ্রডিঙ্গা যুব সংগঠনের প্রচেষ্টায় একটি মাইলফলক অর্জিত হয়।


একটি পাঠাগার কিভাবে একটি গ্রাম পরিবর্তন করে দিতে পারে তার মোক্ষম উদাহরণ হতে ‘আলোর পথে সাধারণ পাঠাগার’। নেত্রকোনা সদর উপজেলার পলাশহাটি গ্রামে পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এলাকার চিত্রই পরিবর্তন হয়ে যায়। সম্প্রতি পাঠাগার এর উদ্যোগে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর সে গ্রামে শিক্ষার হার বেড়েছে, উচ্চ শিক্ষার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কৃষি-সংস্কৃতিসহ নানা ক্ষেত্রেই এসেছে দৃশ্যমান পরিবর্তন।


জেলায় বৃক্ষের গুরুত্ব অনুধাবন করে এবং বৃক্ষ রক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে নেত্রকোনা জেলার ৮৬টি স্কুলে অনুষ্ঠিত হয় নেত্রকোনা জেলার মেগা ইভেন্ট ‘ট্রি অলিম্পিয়াড’। মাওহা গ্রামের যুবকদের যুব উদ্যোগ তো আজ দেশব্যাপী পরিচিত। এভাবেই নানা সময়ে নানাভাবে কখনো পরিবেশবান্ধব প্রচার উপকরণ তৈরি করে, কখনো রাস্তা মেরামত করে, কখনো টিফিনের টাকায় বৃক্ষ রোপণ করে, নবজাতককে বৃক্ষ দিয়ে স্বাগত জানিয়ে, রক্তদান করে, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানবতার এক নজির তৈরি করেছে এই সংগঠনের সদস্যরা। নানান বৈচিত্র্যময় বিষয়ে কাজ করছে তারা। নবজাতকের শশ্রুষা, ঐতিহ্যচর্চা, লোকায়ত জ্ঞান. নদীরক্ষা, পরিবেশবাদী প্রচার উপকরণ ব্যবহার থেকে শুরু করে হালের জলবায়ু ন্যায্যতায় সাইকেল র‌্যালি বা হাওর যুব জলবায়ু উৎসব। এভাবেই নানান ক্ষেত্রে অবদান রেখে তারা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কখনো অনলাইনে, কখনো অফলাইনে নানাভাবে সবার সাথে যুক্ত থেকে কাজ করে যাচ্ছেন এবং একই সাথে সমাজে একটি উদাহারণ তৈরি করার চেষ্টা করছেন, যে আমরা চাইলেই এই সমাজটাকে আরো সুন্দর করতে পারি। আমাদের দেশটাকে আমরাই গড়তে পারি।

“নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস”
আমরা অতিসম্প্রতি নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছি। আমরা এমন একটি সময়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাচ্ছি যখন দৈনিক উল্লেখযোগ্য হারে মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্ত হচ্ছে, প্যালেস্টাইনের আকাশ ধোঁয়ায় কালো হয়ে আছে, ইতি-উতি পড়ে আছে মানুষের লাশ, বাংলাদেশের রেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, হাওরের প্রতিনিয়ত হারানোর শঙ্কা নিয়ে ফসল চাষ করছে। এতো এতো শঙ্কার মধ্য দিয়ে আমরা নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছি। এই ‘শঙ্কা’কে ‘সম্ভাবনা’য় রূপান্তরিত করাই যুব শক্তির কাজ। দুনিয়ার ইতিহাস দেখলেও আমরা তাই দেখবো। গ্রীক পুরাণের প্রমিথিউস কিংবা আমাদের যুগের অ্যাভেঞ্জার্সদের স্পাইডারম্যান, রুশ বিপ্লব অথবা আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা এই শতাব্দীর ভয়াবহ মহামারী করোনা, সংকট যতো গভীরই হোক না কেনো যুব সমাজ বরাবরেরই মতো তাদের শক্তি-সাহস আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পৃথিবীকে বারবার সঞ্জীবনী শক্তি দিয়ে রক্ষা করেছে। দিয়েছে দিশার সন্ধান, আশার আলো। নেত্রকোনা’র সংগঠিত যুব সংগঠনের কাজ শেষ হয়ে যায়নি। এতো সবে শুরু, যেতে হবে আরো অনেক দূর। এই ধোঁয়াশার ভিতর থেকে, ‘নাগিনীর বিষাক্ত নিশ^াস’ এর ভেতর থেকে যুবরাই উদ্ধার করবে পৃথিবীকে। এই যুবসমাজকে তাদের উপর অর্পিত ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকতে হবে। বাঙালীর সাধক, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলেই শেষ করতে চাই-

“নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ^াস
শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস-
বিদায় নেবার আগে তাই
ডাক দিয়ে যাই
দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।”

happy wheels 2

Comments