বৈচিত্র্য সুরক্ষা করি সকলে মিলে স্বদেশ গড়ি: সকল প্রাণ ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন
ঢাকা থেকে পাভেল পার্থ
আয়তনে ছোট হলেও বাংলাদেশ বৈচিত্র্য বৈভবে দুনিয়ায় অনন্য। ৩০টি কৃষিপ্রতিবেশ, ১৭টি হাইড্রলজিক্যাল অঞ্চল, ২৩০টি নদ-নদী, দুনিয়ার বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য, দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, হাজারো ধানের জাত, ৪৫ জাতিসত্তা নিয়ে পৃথিবীর বুকে এক আশা জাগানিয়া স্বপ্নভূমির নাম বাংলাদেশ। এখানে মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি, স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রজাতি ১১৩, পাখি প্রজাতি ৬৩০, সরীসৃপ ১২৫, ২২ প্রজাতির উভচর, ২৬০ প্রজাতির স্বাদুপানির মাছ, সামুদ্রিক মাছ প্রজাতি ৪৭৫, ৩২৭ জাতের খোলসযুক্ত প্রাণী। বাংলাদেশ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ২০১০ সনে ৪র্থ প্রাণবৈচিত্র্য অবস্থানপত্র তৈরি করে। এতে দেশে ১৬ প্রজাতির এনডেমিক উদ্ভিদসহ প্রায় ৩,৬১১ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদের সংখ্যা নথিভূক্ত করা হয়েছে। অবস্থানপত্রে এক হাজার প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদের কথা বলা হয়েছে। বাঘের অঞ্চল হিসেবে খ্যাত বাংলাদেশ ক্রমেই বাঘশূণ্য হয়ে পড়ছে। শুধুমাত্র সুন্দরবনই এখন বাংলা বাঘের শেষ আবাস। ২০০৪ সনের এক জরিপে দেখা যায় সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪০, ২০০৬ সনে দেখা যায় ২০০ এবং সর্বশেষ ২০১৫ সনের জরিপে বাঘের সংখ্যা জানা যায় ১০৬টি। বাঘের মতই কমছে ধানের দেশে ধান জাতের বৈচিত্র্য। বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ১৯৮২ সনের জরিপে দেখায় দেশি ধানের জাতসংখ্যা ১২,৪৮৭। ২০১৪ সনে তারা জানায় জাত সংখ্যা সাত হাজার।
শুধুমাত্র ধান, মাছ, পাখি, বাঘ বা গাছ নয় বাংলাদেশে মানুষের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং ভিন্নতাও আজ বিপদাপন্ন। বাঙালি বাদে অপরাপর ৪৫ আদিবাসী জাতি তাদের মাতৃভাষা, ভূমি ও সংস্কৃতির সুরক্ষায় লড়ছে। নারী-পুরুষসহ সকল লিঙ্গীয় ভিন্নতা আজো সমমর্যাদা পায়নি। শিশু-প্রবীণ-তরুণসহ সব বয়সের জন্য তৈরি হয়নি কাংখিত জায়গা। বিশেষভাবে সক্ষম মানুষেরা এখনও মূলধারার তলানিতেই পড়ে আছে। সবকিছু মিলিয়ে বৈচিত্র্য-বৈভবের বাংলাদেশ ক্রমান্বয়েই বৈচিত্র্যবিমুখ ও বৈচিত্র্যহীন হয়ে পড়ছে। সাংস্কৃতিক ভিন্নতাসহ ভিন্নমতগুলো আজ ভূলুন্ঠিত। এখানে লিচুতে বিষ দেয়া হয় পোকা মারার জন্য। কিন্তু মরে যায় মৌমাছি, এমনকি বিষ দেয়া লিচু খেয়ে মরেছে মানবশিশুও। বৈচিত্র্য আর ভিন্নতা নয়, এখানে বহুজাতিক বাজারই হয়ে ওঠছে মূখ্য। প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন ভোগবিলাসী জীবনের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে আগামীর প্রজন্মকে।
মানুষ কেবলমাত্র মানুষ নয়, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তার চারপাশের জগত থেকে। মানুষ জানতে পারছে না প্রতিদিন কীভাবে সে বেঁচে থাকছে। শ্বাস নেয়ার জন্য তার অক্সিজেন কে জোগাচ্ছে? কে তার মুখের সামনে খাবার হাজির করছে? যে গাছ প্রতিমুহুূর্ত বিনামূল্যে অক্সিজেন বিলিয়ে যায়, নিজের জীবন দিয়ে সকলের জন্য খাদ্য বানায়। সেই গাছের পাতায় আমরা কতজন ভালবাসার হাত রেখেছি? যে মাটি আর জল আমাদের শরীর জীবন্ত রাখে, মানুষ হিসেবে সেই মাটি আর পানির কী প্রতিদান আমরা তৈরি করেছি? একটিবার ভাবা উচিত, যদি আজ দুনিয়ার সব গাছ হরতাল ডাকে। যদি মাটি ও পানি আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তবে মানুষের এত হানাহানি আর সংঘাতের বাহাদুরি দিয়ে কী হবে? কার সাধ্যি আছে গাছ, মাটি, পানি ছাড়া টিকে থাকবে?
প্রাণের বৈচিত্র্য ছাড়া আমরা বাঁচবো না। এমনকি মানুষের সমাজে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য ছাড়াও সভ্যতার বিকাশ হবে না। বৈচিত্র্য জরুরী। প্রাণ, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য। সকল ভিন্নতা ও রূপকে শ্রদ্ধা করে সকলকে নিয়ে সকলের জন্য বেঁচে থাকার রসদ জোগাতে হবে। আর এভাবেই টিকে থাকবে মানুষ, পাখি, মাছ, বাঘ, মাটি, পানি ও গাছ। সকলে মিলেই আমাদের সকলের সংসার। একজন বাচ্চা পাখির অসুখ হলে মানুষই বাড়াবে মমতার আঙুল। ঠিক সেই পাখিও একদিন মানুষের জন্যই গাইবে আনন্দের গান।
জাতিসংঘের সাধারন সভার দ্বিতীয় কমিটিতে প্রথম উত্থাপিত হয় ‘আন্তজার্তিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবসের’ কথা। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এটি পালিত হয় প্রতি বছরের ২৯ ডিসেম্বর। ২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসে আন্তজার্তিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবসের তারিখটি পরিবর্তিত হয়ে পুনরায় এটি ২২ মে নির্ধারিত হয়। ২০১০ সালকে আন্তজার্তিক প্রাণবৈচিত্র্য বর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৬ সনের প্রতিপাদ্য হলো, মানুষ ও জীবনজীবিকার স্থায়িত্বশীলতায় প্রাণবৈচিত্র্যই হোক জীবনের মূলধারা। প্রতি বছর ২১ মে পালিত হয় ‘বিশ্ব সংলাপ ও উন্নয়নের জন্য সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য দিবস’।
প্রকৃতির ভেতর বিদ্যমান প্রাণের বৈচিত্র্য এবং মানুষের সমাজে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আজ উভয়েই সংকটের মুখোমুখি। এই বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা ছাড়া আমাদের প্রিয় পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব। ব্যাক্তি, পরিবার, বর্গ, সমাজ, দেশ সকলে মিলেই আমরা প্রাণ, প্রকৃতি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যর প্রতি জানাই আমাদের অবিরল অসীম গভীর শ্রদ্ধা।
আসুন জেগে ওঠি, সকলে মিলেই জাগিয়ে রাখি প্রিয় স্বদেশ।
বাঁচিয়ে রাখি সৌরজগতের এক সবুজ গ্রহ পৃথিবীকে।