অন্তর মম বিকশিত কর
সিলভানুস লামিন
আমি মাঝে মাঝেই ভাবনা জগতে নিমজ্জিত করি নিজেকে! যখন অবসর পাই, যখন বাস্তব জগতের কিছু কিছু ঘটনা আমাকে বিব্রত করে! এভাবে কোন কোন সময়ে আমি ভাবুক হয়ে যাই! ভাবি মানুষ ছাড়া প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণ ও সৃষ্টি’র মধ্যে কীভাবে যোগাযোগ হয়? যোগাযোগে তাদের পরস্পরের সাথে তারা কী আদান-প্রদান করে? মানুষসহ অন্যান্য প্রাণ ও অস্তিত্বগুলো পৃথিবীতে যদি না থাকতো তাহলে মানুষকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া অনাকাক্ষিত ঘটনাগুলো কী ঘটতো? কারা ঘটাবে? এরকম নানান অবান্তর প্রশ্ন আমার ভাবনালয়ে হাজির হয়। তবে এর উত্তর সন্ধানের প্রচেষ্টা যখনই পরিচালনা করি তখন অনুভব করি আমার মাথার ভেতরে থাকা মস্তিকের মধ্যে একটা কিছু ঘটে যাচ্ছে! তাই কোন কিছু ঘটে যাওয়ার আগেই ভয়ে আমি পুনরায় বাস্তব জগতে ফিরে আসি! তবে ভাবনা জগতে নিমজ্জিত হয়ে যেসব প্রশ্নগুলো আমার মস্তিষ্কের গঠনকে একেবারে উলটপালট করার উপক্রম করেছিলো সেগুলো বাস্তব জগতে এসেও আমাকে ছাড় দেয়নি!
আমি তাই পৃথিবী এবং পৃথিবী প্রতিটি বৈচিত্র্যময় প্রাণ, জীবনসহ অন্যান্য জড়বস্তুগুলোর সৃষ্টির রহস্য এবং মানুষসহ অন্যান্য প্রাণ ও জীবনের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করি। নিজের ক্ষুদ্র জীবনের ‘পরিক্রমা’ পর্যালোচনা করার প্রয়াস চালাই। দেখার চেষ্টা করি, জীবনপ্রবাহে আমি কিভাবে এগিয়ে চলেছি। আমি পর্যালোচনা করে দেখতে পাই, মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য আমি আমার পিতামাতা, আমার ভাইবোন, পাড়াপড়শির ওপর নির্ভর করি; তারাও নানাভাবে ও নানান কায়দায় আমার ওপর নির্ভরশীল ছিলো, আছে। আমি আমার শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে নিজেকে শিক্ষিত করে তুলেছি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। পিতামাতা, ধর্মগুরু ও শিক্ষকদের কাছ থেকে সামাজিক মূল্যবোধ, মানবীয় গুণাবলী শিখে নিজেকে সমাজের একজন যোগ্য সদস্য হিসেবে গড়ে তুলেছি। বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞার্নাজনের জন্য বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের লেখা বই পড়েছি। আমি দেখতে পাই, ছোটকাল থেকে এখন পর্যন্ত আমি প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানকে খাদ্য হিসেবে, ওষুধ হিসেবে, পুষ্টি হিসেবে গ্রহণ করেছি, এই জীবনে কয়েক লাখ টন অক্সিজেন গাছ থেকে গ্রহণ করে বেঁচে আছি এবং বিনিময়ে কয়েক লাখ টন কার্বন ডাই অক্সাইড ছেড়ে গাছপালাকে বাঁচাতে অবদান রেখেছি। আমি দেখতে পাই, নদীতে আমি গোসল করি নিজেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেছি, নদীর মাছ ধরে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছি, মাটিতে ফসল ফলিয়ে সেগুলোও খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছি, বন বাদারে ঘুরে নানানরকম প্রাকৃতিক ফল খেয়েছি, আমার ঘরবাড়িকে সুরক্ষিত করার জন্য আমি গাছপালা থেকে কাঠ সংগ্রহ করি, ঘরকে সুসজ্জিত করার জন্য আসবাবপত্র বানাই। অন্যদিকে নিজের মনকে চাঙ্গা করার জন্য এবং বিনোদন পাওয়ার জন্য বিভিন্ন মনোরম ও মনোমুগ্ধকর নানান প্রাকৃতিক স্থানে ঘুরেছি। আমার এলাকার ছড়া, ঝর্ণা, পাহাড়, টিলা এবং অনেক প্রাকৃতিক কাঠামো পরিদর্শন করে উপভোগ করেছি, মানসিক প্রশান্তি লাভ করেছি। আমি দেখি, এক স্থান থেকে আরেক স্থান যাওয়ার জন্য আমার মতো মানুষের তৈরি যানবাহন ও অন্যান্য ভৌত যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেছি। তথ্য পাওয়ার জন্য আমি মানুষের মস্তিষ্কের অভূতপূর্ব সৃষ্টি প্রযুক্তি ব্যবহার করেছি। আমার মতো মানুষের রচিত নানান জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থ, উপন্যাস, কবিতা, নীতিমালা পড়ে জ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছি। এই উপলদ্ধি থেকে আমি স্পষ্টতই বুঝতে পারি যে, পৃথিবী নামক এই গ্রহ সৃষ্টির পেছনে বিধাতার একটি মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। বিধাতার এই উদ্দেশ্য হতে পারে, প্রকৃতির প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যে যেন একটি আন্তঃনির্ভরশীল সম্পর্ক ও ছন্দময় জীবনব্যবস্থা বিরাজ করে। প্রতিটি সৃষ্টিই যেন পারস্পারিক সহ-অবস্থান ও বাহ্যিক-আভ্যন্তরীণ বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দেয় ও সম্মান করে ভালো থাকে। এছাড়া এই বৈচিত্র্যকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্তঃনির্ভরশীলতা ও আন্তঃসম্পর্ক যেন পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য সম্পর্ক সৃষ্টি করে। কারণ কোন ‘সৃষ্টিই’ অমূলক ও অবান্তর ‘সৃষ্টি’ নয়। প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যেই একটি অলিখিত যোগাযোগ, আন্তঃসম্পর্ক ও আন্তঃনির্ভরশীলতা বিদ্যমান। এই যোগাযোগ, আন্তঃনির্ভরশীলতা ও আন্তঃসম্পর্ক বিঘ্ন ঘটলে পৃথিবী অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।
পৃথিবী নামক এই গ্রহকে অপরূপ রূপে সজ্জিত করার জন্যই বিধাতা সম্ভবত কোটি কোটি প্রাণ (উদ্ভিদ ও প্রাণী) সৃষ্টি করেছেন। এই কোটি কোটি প্রাণের জীবনপ্রণালীকে সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য তিনি বিশাল ও ক্ষুদ্রকার জড়বস্তু (মাটি, পাহাড়, পর্বত, সাগর, সমুদ্র, নদী, ছড়া, ঝর্ণা, আকাশ, বায়ু, আগুন) সৃষ্টি করেছেন। তিনি এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যাতে এই গ্রহের প্রতিটি সদস্যদের মধ্যকার আদান-প্রদান হয়, সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে! এসব সৃষ্টির সম্মিলিত অবদানে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণের প্রতিদিনকার জীবনপ্রবাহ সুন্দরভাবে পরিচালিত হয়েছে। মানুষের উৎকর্ষ মস্তিষ্ক এবং উত্তরোত্তর উন্নতির কারণে এসব জীবন, প্রাণ এবং জড়বস্তুকে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পেয়েছে। সকল সৃষ্টির নেতা বা নিয়ন্ত্রক হওয়ার অর্থ এই নয় যে, মানুষ তার প্রয়োজনে এসব ধ্বংস করবে, হত্যা করবে এবং চিরতরে তাদের অস্তিত্ব মুছে ফেলবে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে! আদিমকালে মানুষ তার খাদ্য সংগ্রহের জন্য জীবজন্তুর সাথে লড়াই করতো কিন্তু মানুষের মস্তিস্কের কারণে সভ্যতার উন্নয়নে এসব জীবনজন্তুকে মানুষ পোষ মানাতে বাধ্য করেছে। সেই কারণে আজ মানুষই পৃথিবী নামক গ্রহের সব ধরনের প্রাণ ও জীবনের নেতা! নেতা হিসেবে তাই মানুষকে বিধাতার প্রতিটি সৃষ্টিকে যত্ন ও পরিচর্যা করার দায়িত্ব পেয়েছে। প্রকৃতি অন্যান্য প্রাণ ও সৃষ্টির চেয়ে তাই মানুষের দায়িত্ব অনেক বেশি! মানুষের এই দায়িত্ব হচ্ছে প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণ ও সৃষ্টিকে তাদের মতো করে চলতে দেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া, তাদের দেখভাল করা এবং সর্বোপরি তাদের ভালো থাকা নিশ্চিত করা! তাই ‘নেতা’ মানুষের লালন-পালন ও পরিচর্যায় প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় প্রাণ ও জীবন এবং অন্যান্য জড়বস্তুগুলো অপরূপ রূপে আর্বিভূত হবে সেটাই হওয়া উচিত। কিন্তু ঘটেছে ঠিক তার উল্টো! মানুষ যত সভ্য হচ্ছে, মানুষের মস্তিষ্ক যত বেশি উৎকর্ষ হয়েছে মানুষ ততবেশি আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। এজন্যই পৃথিবীতে সবচে’ হিংস্র প্রাণী হচ্ছে মানুষ! মানুষই সবকিছু ধ্বংস করেছে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। মানুষ ভুলেই গেছে যে, এই পৃথিবীর একমাত্র বাসিন্দা তারা নয়! এই পৃথিবীর সবকিছু ভোগ ও উপভোগ করা তাদের একার অধিকার নয়; পৃথিবীর অন্যান্য ‘প্রাণ’ ও ‘সৃষ্টি’র অধিকার আছে এই পৃথিবীর সুধা পান করার, এই পৃথিবীতে ভালোমতো বেঁচে থাকার!
পৃথিবীর অন্যতম বাসিন্দা এবং সবচে’ বুদ্ধিমান সদস্য মানুষের আত্মকেন্দ্রিক আচরণ ও আগ্রাসী মনোভাবে কারণে আজ পৃথিবীতে অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। পৃথিবী জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি কতটি প্রাণ ও উদ্ভিদ মানুষের আগ্রাসী আচরণে পিষ্ট হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে সে হিসাব করা কঠিন হলেও এটি দৃশ্যমান যে, পৃথিবীতে দিনকে দিন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে দিনকে দিন পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণ ও জীবনের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষের মৃত্যু হার কমে যাওয়ায় মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে তা সত্যি কিন্তু ইচ্ছে করলে পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণ ও উদ্ভিদের জীবন মানুষ তার উৎকর্ষ মস্তিষ্কের মাধ্যমে বাঁচাতে পারতো সেটা মানুষ ভালো করেই জানে। কিন্তু মানুষ তা করেনি! প্রকৃতির সদস্য হয়েও অন্যান্য সদস্যদের মৃত্যুর জন্য দায়ি মানুষের ওপর প্রকৃতি তাই প্রতিশোধ নিতে পিছপা হয়নি। শুধুমাত্র বিগত ১০ বছরে জলবায়ুজনিত নানান দুর্যোগেই লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, প্রতিবছরই নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসে মানুষের কৃত্রিম উন্নয়নকে তছনছ করেছে। তারপরও মানুষ কিন্তু থেমে থাকেনি প্রকৃতির অকৃত্রিমতাকে তছনছ করতে! কারণ প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের মধ্যে একটি অচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান থাকার বিষয়টি মানুষ অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে বা অনুধাবন ও উপলদ্ধি করতে চায়নি।
এই পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য এবং প্রতিটি প্রাণ ও অস্তিত্বের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক ও আন্তঃনির্ভরশীলতা বাঁচিয়ে রাখার জন্য মানুষের পক্ষ হয়ে হয়তোবা প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান মানুষের এই অপকর্মের জন্য বিধাতার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করছে! মানুষের অন্তরকে বিকশিত করার জন্য মানুষের অন্তরের অন্তরকে (বিবেক) অনুরোধ করেছে! মনে করি, সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ যদি তাদের জীবন পর্যালোচনা করে দেখতো যে, তাদের জীবনে প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণ ও অস্তিত্বের কি কি অবদান রয়েছে তাহলে প্রকৃতির একটি সৃষ্টি বা প্রাণকে হত্যা করার আগে কিংবা বিলুপ্ত করার আগে তারা একশ’বার চিন্তা করতো! তাই তো প্রকৃতিপ্রেমীরা হৃদয় দিয়ে প্রকৃতির বৈচিত্র্য ও বৈচিত্র্যের মাঝে আন্তঃনির্ভরশীলতাকে উপলদ্ধি করেছেন বলে পৃথিবীতে এখনও অনেক প্রাণ ও অস্তিত্ব বেঁচে আছে। তাঁরা তাদের জীবন দিয়ে এসব প্রকৃতির প্রাণ ও অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নিয়েছেন এবং অন্যকেও অুনরোধ করেছেন। আমাদের সবার হৃদয়কে তাই বিকশিত করার উদ্যোগ নিতে হবে যাতে করে আমরা প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণ, উদ্ভিদ এবং বিধাতার অনন্য সৃষ্টিগুলোকে ভালোবেসে তাদের সহ-অবস্থান স্বীকার করতে পারি এবং এই বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিগুলোর মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ককে শক্তিশালী করতে অবদান রাখতে পারি। মানুষের অন্তর বিকশিত হলে তারা (মানুষ) প্রকৃতির প্রতিটি সৃষ্টির মহত্ব উপলদ্ধি করবে এবং এতে করে বাঁচবে মানুষ নিজে, বাঁচবে প্রকৃতির প্রতিটি বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি! আসুন আমরা সবাই আমাদের অন্তরকে বিকশিত করি।