শ্যামনগরে পরিবেশবান্ধব চুলার ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হিসাবে পরিচিতি। এখানে বছরে বারবার ঘুরে ফিরে আসে নানান ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ দুর্যোগের সাথে উপকূলীয় জনগোষ্ঠী অনবরত নানান ধরনের উদ্যোগ ও কৌশল গ্রহণ করে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন স্থানীয় পরিবেশ, প্রতিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার কৃষক-কৃষাণীরা ব্যক্তি ও সংগঠনের সম্মিলিত উদ্যোগে স্থানীয় পরিবেশ, প্রতিবেশ প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। আর তার মধ্যে পরিবেশবান্ধব চুলা ব্যবহার অন্যতম। উপকূলের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের মাঝে দিনে দিনে পরিবেশবান্ধব চুলা ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিগত সময়ে মাঠ পর্যবেক্ষণে শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বিশেষ করে মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের ধানখালী, কালিনগর, কদমতলা, হরিনগর, ইশ^রীপুর ইউনিয়নের ধুমঘাট, কাশিমাড়ি ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনায় পরিবেশবান্ধব চুলার ব্যবহারের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
ধানখালী গ্রামের প্রবীণ কৃষাণী মমতা রানী বৈদ্য বলেন, ‘আমরা উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পরিবেশ বাস করি। যে কারণে এখানে গাছের পরিমাণও কম। ফলে জ¦ালানি সংকট দেখা দেয়। একদিকে গাছ কম হওয়ায় জ¦ালানি কাঠের দাম যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি জ¦ালানি গ্যাসেরও । এছাড়াও এলাকাতে গবাদী পশু ও ধান চাষের জমির পরিমাণও কম। সে কারণে জ¦ালানি সাশ্রয় বিভিন্ন পন্থা আমাদের অবলম্বন করতে হয়। সেদিক থেকে পরিবেশবান্ধব চুলা বেশ ভালো।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি সেই আইলার পর থেকে প্রায ১৫ বছর এই চুলা ব্যবহার করছি। এ চুলা আমার মতো করে গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে ব্যবহার হচ্ছে। আমরা একবার একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলাম। এরপর থেকে এর ব্যবহার চালিয়ে যাচ্ছি।’
জয়নগর গ্রামের কৃষানী রোজিনা বেগম জানান, ‘এই চুলা স্বাস্থ্যসম্মত। এটি আমাদের পরিবেশের জন্য খুবই উপযোগী। এই চুলার নানান গুণাবলী আছে। এতে যেমন ঘর বাড়িতে কোন কালি হবে না, হাড়ি পাতিলেও কালি পড়বেনা, ঘরের মধ্যে কোন ধোঁয়া থাকবেনা, তাপ কম লাগবে। যেকোন জ্বালানি দিয়ে জ্বালানো যাবে। এ চুলা তৈরি করাও খুব সহজ। একবার যে কেউ তৈরি করা দেখলে তিনি নিজে এই চুলা তৈরি করতে পারবেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি আগে সাধারণ চুলা ব্যবহার করতাম। সেখানে কিন্তু নানান ধরনের সমস্যা হতো। সাধারণ চুলায় রান্না করলে হাঁচি এবং কাশি বেশি লাগতো, মাথা ঘুরতো, তাপ লেগে হাত ও মাঝে মধ্যে পুড়ে যেতো, ঘরের মধ্যে কালো হয়ে যেতো। যেদিন থেকে পরিবেশবান্ধব চুলার গুণাবলী সম্পর্কে জানতে পেরেছি সেদিন থেকে এই চুলা ব্যবহার করি। আমরা স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে পরিবেশবান্ধব চুলা ব্যবহার করি। আমি বারসিক নিকট প্রথম এই চুলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি।’
কালিনগর গ্রামের কৃষানী রতœা রানী মন্ডল বলেন, ‘আমি ২০১৬ সালে বারসিক থেকে এ চুলা তৈরির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। আর সেখান থেকে এ চুলা ব্যবহার করছি। আমাদের গ্রামে অনেকেই এটি ব্যবহার করছেন এবং পরবর্তীতে অনেক বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এ চুলা তৈরি ও উপকরণ সহায়তা করেছে। এটি একটি ভালো চুলা। আমাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে এ চুলার জুড়ি নেই। এ চুলা আমরা যেমন ব্যবহার করছি তেমনি অন্যদের ব্যবহার করতে উৎসাহিত করছি।’
প্রাকৃতকি দুর্যোগ মোকাবেলা করে পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে অভিযোজন করার জ্ঞান-অভিজ্ঞতা এদেশের গ্রামীণ জনগণ নিভৃৃতে করে যাচ্ছেন। তার মধ্যে পরিবেশবান্ধব চুলা তৈরি ও ব্যবহার অন্যতম। দিনে দিনে এ চুলার ব্যবহার বৃদ্ধি পাছে এবং এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় সম্প্রসারণ হচ্ছে।