উপকূলীয় অঞ্চলে শত দুর্যোগে যুদ্ধ করে টিকে থাকা মানুষের জীবন থেকে অভিজ্ঞতা বিনিময়

মানিকগঞ্জ থেকে মো. নজরুল ইসলাম
“মানুষে মানুষে প্রাণে প্রাণে, মনে মনে ভিন্ন প্রতিবেশে আন্তঃসম্পকের্র আরো বৃদ্ধি পাক এই স্লোগানে সম্প্রতি দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের সাথে তাদের শত দুর্যোগে যুদ্ধ করে টিকে থাকার গল্প ও জীবন থেকে শিক্ষার এক ভিন্ন অবিজ্ঞতা বিনিময় সফর করলাম। কর্মসূচির আলোকে তাদের সংক্ষিপ্ত বয়ানে অভিজ্ঞতা বলার চেষ্টা করব।
গত ১৮ মার্চ ২০২৩ বারসিক মানিকগঞ্জ রিসোর্স সেন্টার থেকে আমি মো. নজরুল ইসলাম, সহকর্মী রুমা আক্তার. হরিরামপুর চর জলবায়ু সেচ্ছাসেবক টিমের সদস্য ফয়সাল হোসেন ও ঘিওর নালীর আলোর পথ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাইকেল আকাশ নিয়ে শ্যামনগর, মুন্সিগঞ্জ,কলবাড়িয়া বারসিক অফিসের পথে রওনা দিলাম এবং কলবাড়ি বরসা রিসোর্টে এসেই মিজারিও জার্মান প্রতিনিধি ড্যানিয়েল বোস্টন ও বারসিক নির্বাহী পরিচালক সুকান্ত সেনসহ অংশগ্রহণকারিদের সাথে মতবিনিময় সভায় যোগদান করলাম। সপ্তাহব্যাপি কর্মসূচির নির্দেশনায় আছেন বারসিক পরিচালক পাভেল পার্থ, সিলভানুস লামিন ও সমন্বয়কারী জাহাঙ্গীর আলম, উপকূলীয় সমন্বয়কারি রামকৃষ্ণ জোয়ারদার ও বাবলু জোয়ারদার, মফিজুর রহমানসহ সাতক্ষীরা, রাজশাহী, নেত্রকোণা ও মানিকগঞ্জের অংশগ্রহণকারীগণ।
পরদিন সকালে বারসিক কলবাড়ি অফিসে সবাই সকালের নাস্তা করে বরসা রির্সোটের লঞ্চ ঘাটে শ্যামনগর এসএসটি ও সিডিও স্বেচ্ছাসেবীদের সাথে লঞ্চ ঘাটে আসলাম। তারপর সবাই মিলে সুন্দরবন রক্ষায় ট্রলারে ব্যানার ধরে উই ওয়ান্ট জাস্টিস, উই ওয়ান্ট ক্লাইমেট স্লোগানে নিয়ে চুনা নদী দিয়ে কলাগাছিয়ার দিকে রওনা দিলাম। জলাবন দেখতে মনোরম দুপাশে ধুগুধুগু বন আর বন এবং চারিদিকে অথই পানি। রাজশাহীর জামিল, মীম, স্মৃতি, তাসনিম, নেত্রকোনার অর্জুন, আইরিন, রনি, রুমি, নেত্রকোনার জাহাঙ্গীর, রাইসুল, মিলন ও সহকর্মী বাবলু, মফিজ, মানিকগঞ্জ থেকে নজরুল, রুমা,ফয়সাল ও আকাশ এবং ঢাকা থেকে পাভেল পার্থ,সিলভানুস লামিন, জাহাঙ্গীর আলম ভাইসহ সবাই নাচে গানে আনন্দে মেতে উঠলাম। তারপর কলাগাছিয়া ঘাটে এসেই বৈশি^ক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সুন্দবন সুরক্ষায় বিভিন্ন স্লোগান ধরে ব্যানার ফেস্টুন ধরে মানববন্ধন করলাম। তারপর কলাগাছিয়া ইকোপার্কে প্রবেশ করেই বানর ও হরিণ দেখতে দেখতে ক্রোকোডাইল তিন তলা টাওয়ার, কুমিরের বেস্টনী, পুকুর কালভার্ট ও চারপাশে সবুজ নিলাভিরাম সুন্দর, বাইন, কেউরা ও পশুর গাছের মনোরম দৃশ্য দেখে আমরা সবাই মুগ্ধ। বিভিন্ন পয়েন্টে ফটোসেশন তো চলছেই। তারপর দ্রুত ঘাটে এসে ট্রলারে উঠে ভারাক্রান্ত মনে এত কাছের সুন্দরবনকে বিদায় জানাতে হলো। পুনরায় কলবাড়িয়া ঘাটে এসে আবার মানবন্ধন করে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের প্রতি অসীম ভালোবাসা ও বনদস্যু দানবদের প্রতি ঘৃনা জানিয়ে বিদায় নিলাম। সবাই বেশ ক্লান্ত হলেও গবেষক পাভেল পার্থ দার নির্দেশনায় বরসা রিসোর্ট হলরুমে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিরা দ্বন্দ্ব রুপান্তর ও সক্ষমতা বিষয়ক কর্মশালায় বিষয়ভিত্তিক সেশন ও লেখালিখি সাংবাদিকতা বিষয়ক সেশন ও কালচারাল অনুষ্ঠানের জন্য মিলিত হলাম। প্রথমেই প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণের পুনআলোচনা করেন বারসিক প্রকল্প সমন্বয়করি জাহাঙ্গীর আলম এবং ফিচার লিখনের ওপর সেশন পরিচালনা করেন বারসিক নিউজ সম্পাদক সিলভানুস লামিন। তারপর রাতের খাবর প্রস্তুতের আগ পর্যন্ত মানিকগঞ্জ থেকে আমাদের লিজা আক্তার, ফয়সাল হোসেন, সাতক্ষিরা থেকে বিধান মান্ডু, বিশ^জিত দা, নেত্রকোনা থেকে আইরিন হেমব্রম, অর্জুন হাজং ও রনি খান, রাজশাহী থেকে জামাল, মিম ও স্মৃতি ঢাকা থেকে পাভেল পার্থ দা নাচ গান কবিতাসহ সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করেন।


পরদিন বারসিক কলবাড়িয়া অফিসে সবাই সকালের খাবার খেয়ে গবেষক পাভেল পার্থদার নির্দেশনা অনুযায়ী নির্ধারিত ৬টি গ্রুপের টিম লিডারের সাথে মাঠ পর্যায়ে উপকূলীয় মানুষের জীবনকে কাছ থেকে জানা বুঝার জন্য অভিজ্ঞতা বিনিময়ে বের হই। আমাদের টিম লিডার বারসিক উপকূলীয় সহকর্মী মফিজুর রহমান এবং পর্যবেক্ষক পরিবেশবিদ জাহাঙ্গীর আলম। এদিকে গ্রুপ ভাগ করার ফাঁকে রুমে বসেই আমাদের কাজ নিয়ে কথা হয় বারসিক নির্বাহী পরিচালক সুকান্ত সেনের সাথে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কিছুটা ভিজেই কলবাড়ি বাজার থেকে বাইকে নওয়াবেকি বাজারে এসে সবাই একধাপ চা পান করলাম তারপর ফেরিঘাটে নৌকায় ঘাট পারি দিলেই আমাদেরকে স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য মো. আশরাফ হোসেন সাদরে গ্রহণ করলেন। আমরা সুন্দরবনের কূল ঘেষে বঙ্গোপসাগরে উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগরে পদ্বপুকুর ইউনিয়নের কামালকাটি ও পাখিমাড়া গ্রামে বারসিক কমিউনিটির সাথে যৌথ উদ্যোগে ২০১২ সালের বাঁধ রক্ষা বনায়ন প্রকল্প পরিদর্শন ও বৃক্ষরোপণে নেতৃত্বদানকারি স্থানীয় ইউপি সদস্য মো.আশরাফ হোসেন, বন জাকির হোসেন ও প্রবীণ সহাদেব মন্ডল,গীতা মন্ডল, রুপসী মন্ডলদের সাথে তাদের জীবনযুদ্ধের গল্প ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করলাম। শুনতে পেলাম তাদের প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামের গল্প। বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগে, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস,জোয়ার ভাটা ও লবণ পানির সাথে যুদ্ধ করে কিভাবে তারা টিকে আছেন।

জমিতে মিঠা পরিমাণ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে এবং লবণ পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে অন্য ফসল না হওয়াতে বাধ্য হয়েই তারা চিংড়ী চাষ করছেন। সেখানেও তারা বড় ব্যবসায়ী মধ্যস্বত্বভোগী ও বাজার সিন্ডিকেটের কাছে লোকসানের শিকার হন। অনেক চিংড়ী চাষী উপযুক্ত দাম না পেয়ে ঋণগ্রস্ত হওয়ার উপক্রম হন। পানিতে লবণাক্ত বৃদ্ধিসহ কারেন্ট জাল নেট জাল ও রাসায়নিক প্রয়োগে দেশী মাছের আকাল বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রাকৃতিকও মনুষ্য সৃষ্ট এই সব নানা কারণে এলাকার প্রতিবছর ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য ও বর্ষপুঞ্জি ভেঙে যাচ্ছে। আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগে এমনটা ছিল না, এখনই জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক ফলাফল বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এগুলো মোকাবিলায় স্থানীয় পদ্ধতিতে তারা চাষবাস করে কোনমতে টিকে আছেন। আমরা উপকূলীয় অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সরকারের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তারপর দুপুরে বন জাকির ভাইয়ের বাড়িতে দুপুরে হরেক রকমের ভোজন বিলাসী খাবার খেয়ে সবাই মহাখুশি। তারপর পদ্মপকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যন মো.আমজাদুল ইসলামের একটি সাক্ষাতকার নেয়া দরকার। তাৎক্ষণিকভাবে সহকর্মী মফিজুর রহমান চেয়ারম্যাানকে ফোন করে আমাদের কাছে নিয়ে এলেন এবং রাস্তায় দাঁড়িয়েই চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য চিত্ত মন্ডলের সাথে কুশল বিনিময় ও আমাদের রাজশাহীর সহযোদ্ধা সাংবাদিক স্মৃতি আক্তার আদ্যেপ্রান্তে সাক্ষাতকার নিলেন।

এই অভিনব কায়দায় জনপ্রতিনিধিদের সাথে আন্তঃসম্পর্কের জন্য সহকর্মী মফিজুর রহমান ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তারপর আমরা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নওয়াবেকি ঘাটে এসে আরেকদফা চায়ের আড্ডা দিলাম। দোকানের সামনেই চিংড়ীর রেনু পোনার কার্টন দেখে অবাক হলাম এবং বর্তনমান মেম্বার আশরাফ ভাইয়ের ছোট ভাই, বন জাকির ভাইয়ের সাথে আড্ডার ফাকে চিংড়ীর পোন ও চিংড়ী চাষের খোঁজ খবর জানলাম। আমাদের দেখে দোকানের সামনে অনেক মানুষের ভিড় জমে গেলো। সকলের নাম বলতে পারছি না তবে সবাই বেশ আন্তরিকতার সহিত আমাদেরকে তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করার জন্য কমিউনিটির সকল মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা অশেষ। তারপর নওয়াবেকী ঘাট হয়ে কলবাড়িয়া বরসা রির্সোটে এসে একটু বিশ্রাম নিবো। এদিকে মফিজ ভাইয়ের কাছে খবর এলো আমাদের সহকর্মী চম্পা মল্লিক একই কাজে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হন এবং মাথায় গুরুতর আহত হয়ে সাতক্ষিরা হয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজে ভর্তি আছেন। আমরা সবাই খুবই চিন্তিত। হাসপাতালে আমাদের উপকূলীয় সহকর্মী গাজী ইমরান ও রুবিনা পারভিন আছেন।
পরদিন সমাপনি কর্মসূচি হওয়ার কথা ছিলো শ্যামনগর সদর ইউনিয়নে বেশ বড় আকারে সেটিও চম্পা দিদির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাতিল করে ছোট পরিসরে বরসা রির্সোটেই করা হলো। কমিউনিটি থেকে ঘুরে এসে কিছু মানুষের অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়-


১. সহাদেব মন্ডল: তিনি পদ্মপুকুর ইউনিয়নের কামালকাটি গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ মুরুব্বী। তিনি বলেন, ‘আমি বৃটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমল দেখেছি এবং দেখছি। আগের কথা কইলে কেউ বিশ^াস করবে না। এই গ্রামে আমরা ধান, সবজি চাষ করতাম,গোয়ালে গুরু ছিল নদীতে দেশী মাছ ছিলো। সারা বছর ঘরের ধানের ভাত খাইতাম। এখন প্রাকৃতিকভাবে ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য নেই, দুর্যোগ, বন্যা খরা ও জলোচ্ছাস অসময়ে হচ্ছে। পানিতে এত লবণ যে হাত ধোয়ার উপায় নেই। মহিলারা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। দিন যাচ্ছে আর সমুদ্র থেকে লবণ পানি আমাদের ভাসিয়ে দিচ্ছে। সামনে যে আরো কি দেখুম তার কথা জানিনা। আমি আর এমন দুর্যোগ দেখতে চাইনা, প্রভু সবার জীবনে মঙ্গল আনুক।


২. মো. আশরাফ হোসেন: পদ্মপুকুর ইউনিয়নের দীর্ঘদিনের সাবেক ইউপি সদস্য ও প্যানেল চেয়ারমেন মো. আশরাফ হোসে একজন সাদা মনের মানুষ। তিনি সারাদিন আমাদের সময় দিয়েছেন এবং তার জীবন ্ও এলাকার কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিনিয়তই আমাদের শত দুর্যোগের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। আমরা আইলা, হারিকেন, নার্গিসের মতোন দুর্যোগ মোকাবিলা করেছি। সরকারি সংকেত শুনে আমরা বারসিক ও স্থানীয় সংগঠন যৌথভাবে মানুষদের সচেতন করতে আশ্রয়ন প্রকল্পে আহবান করেছি। প্রতিদিন জোয়ার ভাটায় বাঁধ ও রাস্তা ভেঙে যাচ্ছে। মাটিতে লবণের পরিমাণ বেশি হওয়াতে বাঁধ থাকছে না। নদীতে দেশী মাছ না থাকার অন্যতম কারণ হলো কারেন্ট জাল ব্যবহার, রাসায়নিক প্রয়োগ ইত্যাদি। জমিতে লবণ পনি বৃদ্ধি পাওয়াতে অন্য কোন ফসল হয়না বিধায় আমরা চিংড়ী চাষ করি। কিন্তু চিংড়ী ঘেরে বর্তমানে সার বিষ কিটনাশকসহ প্রচুর মূলধন লাগছে। বাজার সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে কৃষক মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমরা এই সকল সমস্যসহ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় করনীয় বিষয়ে কৃষি অফিসসহ সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি এবং আপনাদের মাধ্যমে জোর দাবি জানাচ্ছি।


৩. জীবন সংগ্রামে একজন শিশু জয় বাইন: বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরে কূল ঘেঁষে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা। এই জেলার সবচেয়ে বড় উপজেলা উপকূলীয় ১২টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত শ্যামনগর উপজেলা। শ্যামনগর মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের কলবাড়িয়া বরসা রিসোর্টের পাশেই স্কুল শিক্ষার্থী শিশু জয় বাইনদের বাড়ী। জয় বাইন তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। সে বলে, ‘আমরা প্রতিদিন লবণ পানির সাথে খেলা করি। আমার বাবা ও মা নদীতে মাছ ধরে ও বনে মৌয়ালদের সাথে কাজ করেন। আমরা গরিব মানুষ। বাবা মায়ের কষ্ট বুঝি। নদীতে প্রতিদিন জোয়ার ও ভাটা হয়। আমরা জোয়ার ভাটায় খেলা করি। মাছ ধরা আমার নেশা। বিশেষ করে চিংড়ি, কাকরা, ফেসা মাছ ধরে খবই আনন্দ পাই। বেশি ধরতে পারলে বিক্রি করি। এগুলো দেশি মাছ বলে দাম ও চাহিদা বেশি। সবদিন মাছ হয়না কেন জানিনা। তবে আমার মনে হয় কারেন্ট জালসহ রাসায়নিকের কারণে আমরা মাছ পাইনা। আমি সরকারের কাছে এই জাল নিষিদ্ধসহ নদীকে বিষ মুক্ত রাখার দাবি জানাই।


৪. অভিজ্ঞতার আলোকে আরো বলতে গেলে- নেত্রকোণার কলমাকান্দার লেঙ্গুরা গ্রামের মেয়ে সুস্মিতা হাজংদের এলাকা প্রতিবছর পাহাড়ি ঢলে আক্রান্ত হয়। পাহাড়ের বালিতে নষ্ট হয় ফসলের জমি, বাড়ছে পানি সংকট। রাজশাহীর তানোরের মুন্ডুমালার মেয়ে আইরিন হেমব্রমের গ্রামে পানির খুব অভাব। অনাবৃষ্টি আর খরার প্রতিবছর নষ্ট হয় ফসলের জমি। মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের ‘চর জলবায়ু স্বেচ্ছাসেবক টিমের’ সদস্য ফয়সাল হোসেনদের চরে নদীভাঙন বাড়ছে। মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, নেত্রকোণা ও ঢাকার জলবায়ু সংকটাপন্ন এলাকা থেকে এমন যুব তরুণ শিক্ষার্থীরা অংশ নিলেন ৪ দিন ব্যাপি এক প্রায়োগিক যুব জলবায়ু কর্মশালায়। যুবদের প্রত্যেকেই নিজ এলাকায় যুব সংগঠনের মাধ্যমে জলবায়ু ও পরিবেশ সচেতনতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। শ্যামনগরের ‘সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিমের (এসএসএসটি)’ সদস্য রাইসুল ইসলাম নানা এলাকা থেকে আগত যুবদের নিয়ে গেলেন গাবুরার চকবারা গ্রামে। শ্যামনগরের ৬টি ইউনিয়নের ৬টি গ্রাম ও সাতক্ষীরা বনরেঞ্জে আয়োজিত এই কর্মশালায় শ্যামনগরের এসএসএসটি এবং সিডিওর যুব সংগঠকেরা ভিন্ন ভিন্ন এলাকার তরুণদের নিয়ে দলগতভাবে উপকূল ঘুরিয়ে দেখালেন। অংশগ্রহণকারীরা উপকূলের কৃষক, বনজীবী, জেলে, মুন্ডা-বাগদী, উন্নয়নকর্মী, শিক্ষক, স্থানীয় সরকার, জনসংগঠন ও যুব প্রতিনিধিদের কাছ থেকে জানলেন জলবায়ু সংকট, দ্বন্দ্ব এবং টিকে থাকার কৌশলগুলো।


নিজের চোখে দেখলেন জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এবং উপকূল মানুষের জীবনসংগ্রাম। ভিন্ন ভিন্ন এলাকা থেকে আগত তরুণেরা জানালেন, সব এলাকাতেই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে এবং এ কারণে সবার জীবনে বাড়ছে সংকট। দেশের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের যুবরা উপকূল অঞ্চলের জলবায়ু সংকট এবং বেঁচে থাকার সংগ্রামকে খুব কঠিন দুঃসহ বাস্তবতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কর্মশালার অংশ হিসেবে যুবরা ‘সুন্দরবনকে প্লাস্টিক ও বিষমুক্ত রাখার দাবিতে’ মুন্সীগঞ্জ থেকে কলাগাছিয়া পর্যন্ত এক জলবায়ু প্রচারাভিযান আয়োজন করেন যুবরা। কাগজ ও কাপড়ে হাতে লেখা বিভিন্ন ব্যানার ও ফেস্টুনের মাধ্যমে যুবরা জানান, বিশ^ ঐতিহ্য কেবল দুর্যোগ থেকে দেশকে বাঁচায় না বরং বিশে^ও এই বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন পৃথিবীর এক বৃহত কার্বণ শোষণাগার। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততা, জোয়ারের উচ্চতা এবং দুর্যোগ বৃব্ধির প্রভাব থেকে এই বনকে বাঁচাতে হবে পৃথিবীর টিকে থাকার স্বার্থে।


দেশের সব তরুণ যুবদেরকেই সচেতনভাবে এই দায়িত্ব নিতে হবে। আটুলিয়ার বিড়ালাক্ষী, সদরের কালমেঘা, মুন্সিগঞ্জের মথুরাপুর, গাবুরার চকবারা, ঈশ^রীপুরের ধূমঘাট, বুড়িগোয়ালিনীর আশ্রয়নকেন্দ্র, পদ্মপুকুরের কামালকাঠি গ্রামে ঘুরে ঘুরে যুবরা জানতে পারেন ৪০ বছর আগে এলাকায় যেসব ধান, মাছ, গাছ, পাখি ও বন্যজীবজন্তু ছিল সেসব এখন হারিয়ে গেছে। যুবরা জানতে পেরেছেন এলাকার দুর্যোগ পঞ্জিকাও বদলে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক, কৃষি, স্বাস্থ্য, খাদ্য এবং পানি সংকট তৈরি হয়েছে। প্রতিদিন নানা ধরণের পারিবারিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। এক কমিউনিটি থেকে এসেই সবাই মিলে আবার বুড়িগোয়ালিনি কৌশুলা মুন্ডাদের বাড়িতে এসে তাদের সাথে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বেশ আনন্দময় গান,হুক্কাটানা,কাকড়া ধরা ও হাড়িয়া তৈরীর কৌশল অবগত হলাম। তাদের সাথে উপস্থিত আদিবাসীরাও গান করলেন। আসার পথেও আমরা গান করতে করতে অফিসে আসলাম। রাতের খাবার খেয়ে রুমে আসলাম। জলবায়ু সংকট সামাল দিয়ে ভিন্ন এলাকার জনগোষ্ঠী কিভাবে টিকে থাকে এবং অভিযোজনচর্চাসহ তাদের জলবায়ু ঝুকি মোকাবিলা কৌশলে উদ্যমী যুবরা অবিজ্ঞতা গ্রহণ করেন এবং তারা তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সোচ্চার ভূমিকার কথা বলেন।


এদিকে পরদিন প্রায় সবাই বিদায় নিবে,আমাদের মাইকেল আকাশ একটু জ¦রে আক্রান্ত তাই সে সমাপনী অনুষ্ঠান করে যাবেই। তার সাথে যুব নেতা ফয়সাল হোসেনও যুক্ত হলো বলে তাদের হিসাব কিতাব বুঝিয়ে বিদায় দিলাম। আমরা পরদিন সকালে আসছি বলে আমরাও প্রস্তুতি নিচ্ছি। এদিকে আমার রুম মেম্বর অজুর্ন হাজং ও সাংবাদিক হাবিবুর হাসন ভাই খুবই আন্তরিক মানুষ এবং পাশেই আছেন কমরেড স¤্রাট,জাহাঙ্গীর ও উত্তম কুমার। এদিকে গবেষক পাভেল পার্থ সকল রুমেই ঘুরে এবং গল্প জুরে বসেন। দাদার গল্পে মজে গেলে সময়ের প্রতি খেয়াল থাকে না। রাত দুইটা-তিনটার আগে একদিনও ঘুমাতে পারিনি তবুও ক্লান্ত হইনি। চারদিনের কর্মশালা হলেও প্রায় এক সপ্তাহ ব্যাপি এই মহতী কর্মে বারসিক উপকূলীয় সমন্বয়কারি রাম কৃষ্ণ জোয়ারদার, বাবলু জোযারদার, মফিজুর রহমান, রান্না কাজের সহায়তায় প্রশান্ত ও সুশান্ত দাদাসহ সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা অশেষ।

happy wheels 2

Comments