আষাঢ়ের তাপদাহে বরেন্দ্র ভূমি
রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার
আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল বহুল পরিচিত একটি কথা। আষাঢ় মাসে একটানা বৃষ্টির জন্য বাইরে বের হওয়া দায় হয়ে পড়ে এমন অভিজ্ঞতা হয়ত সবারই হয়ে থাকবে। আমাদের ঋতু বৈচিত্র্যর মধ্য বর্ষা অন্যতম কারণ এ সময় প্রকৃতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। কিন্তু বরেন্দ্র অঞ্চলে আষাঢ়ের শেষে এসেও মিলছে না বর্ষা/বৃষ্টির দেখা। প্রকৃতির এ পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ অঞ্চলের কৃষি। এখানে উল্লেখ্য যে, বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি একটি বড় সমস্যা। যা ফসল চাষাবাদে দিন দিন আরো প্রকট হয়ে উঠছে। এর মধ্য জ্যৈষ্ঠ মাসের ১৫ তারিখের পর আষাঢ়ের শেষ পর্যন্ত তেমন বৃষ্টি না হওয়া এবং রোদের প্রখরতার কারণে চলতি আমন চাষ আজ হুমকির মুখে। আবার জনজীবন হয়ে পরছে দূর্বিসহ। বৃহত্তর বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজশাহীর বিশেষ করে তানোর, গোদাগাড়ী এলাকায় এ সংকট অতি প্রখর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ অঞ্চলের বৃষ্টিনির্ভর আমন চাষ হয়ে পরেছে পুরোটাই ভূ-গর্ভস্থ পানি সেচের উপর।
চৈত্র্যর তাপ সহ্য করা যায়, আষাঢ়ের নয়
চৈত্রÑবৈশাক মাসে এ অঞ্চলে এমনিতেই প্রচন্ড রোদ আর তাপের কারণে জনজীবন স্থবির হয়ে পরে। তবে এসময় খরাপ্রবণ এ অঞ্চলের মানুষেরা প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারে বলে ক্ষতি বা কষ্ট কম হয়। রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার গোকুল-মোথুরা গ্রামের শ্রী রমেন্ত্রনাথ সূত্রধর(৮২) বলেন, ‘এ বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের ১৫ তারিখের পর আজ আষাঢ়ের ২৯ তারিখ আমাদের এলাকায় আর তেমন বৃষ্টি হয়নি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত প্রখর রোদ। আষাঢ় মাসের এ তাপ সহ্য করা যায় না কারণ এ সময় এত রোদ আর তাপ সাধারণত হয় না। কারও কোন প্রস্তুতি থাকে না।’
আষাঢ়েও জমি খরখরে মাটি
আষাঢ়ের ১ম সপ্তাহে হালকা বৃষ্টি হওয়ার পর কৃষকরা জমিতে একটি করে চাষ দিয়ে রাখেন। যাতে জমির ঘাস মাটির নিচে পরে যায় পঁচে সার হয়ে যায়। এরপর বেশি বৃষ্টির হওয়ার সাথে সাথে জমি চাষ দিয়ে ধান রোপণ করে দেওয়া যায়। এবার বৃষ্টি না হওয়ার কারণে একটি করে চাষ দেওয়া জমিগুলোর মাটি খরখরে হয়ে আছে। মাটিতে কোন রস নেই। তানোর উপজেলার বাঁধাইর ইউনিয়নের ঝিনাপাড়া,জুমারপাড়া গ্রামগুলোতে ঘুরে দেখা যায় কোন কোন জমির মাটি চৈত্র মাসে জমি চাষ করলে যেমন হয় তেমন হয়ে আছে। এ বিষয়ে জুমারপাড় গ্রামের কৃষক মোঃ আলতাপ উদ্দিন (৪২) বলেন, ‘আমাদের এ এলাকা এমনিতেই অনেক খরাপ্রবণ। কিন্তু এবার আষাঢ় মাসেও যে ভাবে খরা হচ্ছে তাতে আমাদের একটি মাত্র ফসল আমন চাষ করতেও অনেক ক্ষতি হবে।’
বৃষ্টি নির্ভর নয়, আমন এবার সেচ নির্ভর
তানোর ও গোদাগাড়ি উপজেলার গ্রাম গুলোতে যে জমিগুলো বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তপক্ষের গভীর নলকুপের আওতায় আছে সে জমিগুলোতে সেচের মাধ্যমে ধান রোপণ করার কাজ শুরু হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে এ কাজ বৃষ্টির পানি দিয়ে হলেও এ বছর শুধু গভীর নলকুপ থেকে সেচ দিয়ে করতে হচ্ছে। এতে যেমন ফসল চাষ করতে খরচ বাড়ছে তেমন বাড়ছে পানির লেয়ারের গভীরতা। পাশাপাশি সেচের জন্য গভীর নলকুপে পানির সিরিয়ালের জন্য বাড়ছে কৃষকদের লাইন। তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামের মোঃ গোলাম মোস্থফা (৪৩) নামের একজন ডিপের ম্যানেজার বলছিলেন, ‘এ সময় ২৪ ঘণ্টাই ডিপ চালাতে হচ্ছে তারপরও পানি দিয়ে শেষ করতে পারছি না। বিগত বছরে এসময় ডিপের ঘরেই আসতে হতো না।’ এই গ্রামের অপর একজন কৃষক মোঃ মুজাহারুল ইসলাম (৫২) বলেন, ‘আমি এবার ৮ বিঘা জমিতে আমন ধান রোপন করেছি পুরোটাই ডিপ থেকে পানি দিয়ে। এখন জমিতে পানি শূন্য হয়ে গিয়েছে আবার পানি নেওয়ার জন্য প্রতিদিন ডিপের চালকের কাছে যোগাযোগ করতে হচ্ছে। শুধু পানি নিতেই আমার এ বছর বিঘা প্রতি বাড়তি খরচ হলো ১২০০টাকা যা অন্য বছর হয়নি।’
আমনের ফলন কমে হবে
আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহে একটু বৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে জমিতে একটি চাষ দিয়ে রাখার পাশাপাশি আমন ধানের বীজতলা তৈরি করা হয়। এরপর এ অঞ্চলে আষাঢ়ের ৩০ তারিখরে মধ্যই ধান রোপণ করে দেওয়া হয়। কারণ একটু আগে ধান রোপণ করলে এ অঞ্চলের অন্যতম অর্থকরি ফসল আলু চাষে সুবিধা হয়। কিন্তু এবার ধান বীজের বয়স হয়ে গেলেও পানির জন্য ধান রোপণ না করতে পারার কারণে আমনের ফলন কম হবে। এ বিষয়ে যোগিশো গ্রামের মোঃ মনির বলেন, ‘আমি আষাঢ়ের ১ তারিখে ৪ বিঘা ধান রোপণের জন্য বীজতলা তৈরি করি কিন্তু পানির অভাবে ধান রোপণ করতে পারছি না। ডিপে ঘুরে ঘুরে পানি পাচ্ছি না। এদিকে ধানের চারার বয়স হয়ে গিয়েছে। আর ধানের চারার বয়স হলে ফলন কমে যায়।’
অনুভূত হচ্ছে লু-হাওয়া
অনেক বেশি তাপমাত্র আর বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকলে গরম হয়ে যায়। মরুভূমিতে সাধারণত এরকম হাওয়া দেখা যায়। বরেন্দ্র অঞ্চলেও এমন আবহাওয়া দেখা যায় সাধারণত চৈত্র-বৈশাখ মাসে। কিন্তু এবারই প্রথম আষাঢ় মাসের শেষে এসে এ অঞ্চলে অনুভূত হচ্ছে লু-হাওয়া। এ বিষয়ে তানোর উপজেলার আইরা গ্রামের মোঃ আনারুল ইসলাম (৫৫) বলেন, ‘রোদ থাকা অবস্থায় ঘরের বাহিরে বের হওয়া যাচ্ছে না মুখে এসে গরম বাতাস লাগছে সহ্য করা যায় না।’ এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আষাঢ়ে বৃষ্টি হলে মাটি ভিজে থাকে তাপ উঠে না। কিন্তু এবার বৃষ্টি না থাকার কারণে মাটি থেকে গরম ভাপ উঠছে। এ গরম ভাপ আর রোদের তাপ মিলিয়ে লু-হাওয়া তৈরি হচ্ছে।’
আষাঢ় মাসে এমন আবহাওয়া এক কথায় প্রকৃতির পরিবর্তন বলে মনে করছেন জনগোষ্ঠির সদস্যরা। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টি এখানে তেমন চর্চা না হলেও। আদতে এটা জলবায়ু পরিবর্তনেরই উদাহরণ।