মানিকগঞ্জের হরিহরদিয়া চরে ৩০ ধরনের আউশ ধানের প্রায়োগিক গবেষণা
হরিরামপুর মানিকগঞ্জ থেকে মুকতার হোসেন ও সত্যরঞ্জন সাহা:
চলতি আউশ মৌসুমে মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার হরিহরদিয়া চরের কৃষক সংগঠন ও বারসিক-হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ রিসোর্স সেন্টার’র যৌথ উদ্যোগে হরিহরদিয়ায় চরের আবহাওয়া উপযোগি ধানের জাত নির্বাচনের লক্ষ্যে এই প্রথম আউশের ৩০ টি জাত নিয়ে চরের কৃষকরা প্রায়োগিক কৃষিগবেষণা শুরু করেছেন। হরিরামপর উপজেলার লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের কবিরপুর, সেলিমপুর, হরিহরদিয়া, জয়পুর চকে (মাঠে) কৃষকগণ এখনও বোনা আউশ ধানের চাষ করেন। বিস্তৃত চক জুড়ে বোনা আউশের সবুজ শ্যামলিমা, বাতাসে সবুজ ধানের দোল খাওয়া দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। এখানকার কৃষকরা আউশ মৌসুমে সাধারণত পরাঙ্গী ও কালামানিক ধান চাষ করে বন্যার আগেই ঘরে তোলেন। চরে রোপা আমন বন্যার কারণে চাষাবাদ করা সম্ভব নয় আর বোরো ধান সেচ সুবিধা না থাকায় চাষাবাদ হয় না বললেই চলে। তাই আউশই এখানকার কৃষকের প্রধান ধান। কৃষকরা আউশের হাতে গোনা দুইটি জাত পরাঙ্গী ও কালামানিক চাষ করেন যা কোনো কোনো বছর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে হরিহরদিয়া কৃষক সংগঠন ও বারসিক হরিহরদিয়া গ্রামে আউশের উপযোগি জাত নির্বাচনের লক্ষ্যে জাতগবেষণা ও বীজ সংরক্ষণ কাজের উদ্যোগ নেয়। কৃষকদের এই কাজে বিভিন্ন ধরনের আউশের বীজ দিয়ে সহায়তা করে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত লেছড়াগঞ্জ চর উন্নয়ন কৃষক সংগঠন’র প্রতিষ্ঠিত ‘বৈচিত্র্যময় ফসলের বীজ সংরক্ষণ কেন্দ্র’ ও বারসিক।
কৃষকের জমিতে গবেষণাধীন ৩০ ধরনের আউশের মধ্য থেকে কৃষকদের পছন্দের জাত নির্বাচনের লক্ষ্যে এই কাজটি পরিচালনা করছেন হরিহরদিয়া গ্রামের কৃষক সংগঠনের কয়েকজন আগ্রহী কৃষক। তারা কোন ধানের কুশির সংখ্যা বেশি, পোকা কম, গাছের উচ্চতা, শীষের দৈর্ঘ্য, শীষে ধানের সংখ্যা ইত্যাদি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছেন। গবেষণা দলের কৃষক মোন্নাফ শিকদার (৪৮) বলেন কম সময়ে পাকে ও উৎপাদন ভাল হয় এমন আউশ ধানের জাতই ৩০ টি জাতের মধ্য থেকে নির্বাচন করবেন। কেননা বর্ষা বা বন্যার আগে আউশ ধান ঘরে তুলতে হলে কম সময়ে পাকে এমন জাতের ধান চরের জন্য খুবই উপযোগি। তিনি জানান চরের মাটিতে চাষাবাদে সার, বিষ লাগে না, খরচ সাশ্রয়ী বলে তারা স্থানীয় এই ধানই বেশি পছন্দ করেন।
হরিরামপুর চরে আউশের পরাঙ্গী ধানটি বহুকাল থেকেই চাষ হয়। পরাঙ্গী আউশ ধানটি অনেক সময় আগাম বর্ষার পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয় এজন্য বর্ষা আসার আগে আউশের খন্দ বা আউশ ধান ঘরে তুলতে পারলে চরের কৃষক লাভবান হবেন। এজন্য চরের কৃষকের প্রয়োজন আউশ মৌসুমে কম সময়ে পাকে এমন জাতের ধান। এই জন্যই কৃষকরা আগ্রহের সাথেই কাজটি করছে এমনটি জানান লেছড়াগঞ্জের কৃষক মো. আব্দুর রাজ্জাক (৪৫)। এর আগেও চরের কৃষকদের চাহিদা, আগ্রহ ও ধানজাতবৈচিত্র্য বাড়াতে বারসিক- হরিরামপুর রিসোর্স সেন্টার ফরিদপুর জেলার কানাইপুর থেকে কালোআউশ ধানের বীজ এনে কৃষকদের দিয়ে সহযোগিতা করেছে। চরে অপেক্ষাকৃত উচু জমিতে আউশ ধান বপন করা হয় বৈশাখ মাসে আর ধান ধান কাটা হয় আষাঢ় শ্রাবণে বন্যা আসার আগেই। চরের একবারে নিচু জমিও যাতে চাষাবাদের আওতায় আনা যায় এজন্য বারসিক কৃষকদের হিজল দিঘা, মধুশাইল, শিশুমতি, দিঘা ও ডেপু ধান বীজ দিয়ে সহায়তা করেছে যা বর্তমানে চরের কৃষকরা চাষাবাদ করছেন।
স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চার মধ্য দিয়েই চরের দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবেলা করে জীবন-জীবিকা টিকিয়ে রাখা সম্ভব। হরিহরদিয়া চরে কৃষকদের পরিচালিত এই প্রায়োগিক ধান গবেষণা কাজের মাধ্যমে চর-উপযোগি আউশ ধানের জাত নির্বাচিত হলে কৃষকদের চাষাবাদে ঝুঁকি যেমন কমবে একই সাথে দুর্যোগ সহনশীল বিভিন্ন জাতের ধানের সহজলভ্যতা তাদের বীজ নির্ভরতায় আতœবিশ্বাস যোগাবে। আর এভাবেই চরের দুর্যোগ ঝুঁকি কিছুটা হলেও কমবে বলে কৃষকরা মনে করেন।