দিনমজুর শহর আলীর সফলতার গল্প
সিংগাইর থেকে শিমুল বিশ্বাস: “আমি ভাববার পারি নাই যে দ্যাশের কৃষি মন্ত্রীর সাথে আমার পরিচয় অইবো। আমারে অনেক সম্মান দিছেন তিনি। আমার আর চাওয়ার কিছু নাই” কথা গুলো বললেন সিংগাইর উপজেলার নয়াবাড়ি আদর্শ গ্রামের কৃষক শহর আলী (৫৮)। কৃষক শহর আলী আজ প্রতিষ্ঠিত। পরিচিতি পেয়েছেন নিরাপদ খাদ্য উৎপাদক হিসাবে। তার উৎপাদিত কৃষি পন্য স্থানীয় বাজারে যেমন চাহিদা রয়েছে, তেমনি আস্থা জায়গা তৈরি করে নিয়েছে সম্প্রতি শুরু হওয়া সরকার নিয়ন্ত্রিত “কৃষকের বাজারে”। ঢাকা সেচ ভবনের সামনে শুরু হওয়া কৃষকের বাজারের সাথে যুক্ত হয়ে তিনি সপ্তাহে ৮-৯ হাজার টাকা আয় করতে পারছেন। তাছাড়া শহর এবং তার স্ত্রী জয়তুন বেগম দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত আছেন ঢাকার “প্রাকৃতিক কৃষি বিপনন কেন্দ্রের” সাথে। প্রতি সপ্তাহে তিন দুইবার পন্য সরবরাহ করেন। প্রাকৃতিক কৃষি বিপনন কেন্দ্রে পন্য বিক্রয়ের মাধ্যমে প্রতিমাসে গড় আয় ১০ হাজার টাকা। কৃষি কাজ করে দুই ছেলে বিদেশে পাঠিয়েছেন। এখন তিনি অর্থনৈতিক ভাবে যেমন সচ্ছল, তেমনি একজন আদর্শ কৃষক হিসেবেও সামাজিক ভাবেও সম্মানিত।
শহর আলীর দিন এমনটা ছিলোনা। একটা সময় তাকে সংসার চালানোর জন্য দিন মজুরের কাজ করতে হতো। পিতা মোনসের আলী ছিলেন একজন কৃষক। পিতার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিলো না। যে কারণে পিতা মোনসের আলী তাকে বিয়ে দিয়েই পৃথক করে দেন সংসার থেকে। নিজের পরিবারকে ভালো রাখার জন্য দিনমজুরীর টাকা জমিয়ে শাড়ী কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসার আয় থেকে যুক্ত করেন আরো কিছু পুঁজি। অধিক লাভের আশায় কাঁচা মালের আড়ত দেন তিনি। কিন্তু ভাগ্য তাকে সহায়তা করে নাই। হারিয়ে ফেলেন সব পুঁজি। এ অবস্থায় সাহয্যের হাত বাড়িয়ে দেন বায়রা এলাকার ‘স’ মিল মালিক মো: সৈয়দ আলী। সৈয়দ আলীর দেওয়া অর্থ দিয়ে কাঠের ব্যবসা শুরু করেন। এ ব্যবসায় লাভবান হন তিনি। পরিশোধ করেন বিগত দিনের ৯ লক্ষ টাকার দেনা।
কৃষক পরিবারের সন্তান হওয়ার কারনে কৃষি কাজের উপর ঝোঁক ছিলো শহর আলীর। তাই নিজের বাপ দাদার পেশাকে আকঁড়ে ধরে বাঁচার মানসিকতা তৈরি হয় তার। দুই বিঘা বন্ধকী জমিতে কৃষি কাজ শুরু করেন। প্রাথমিক ভাবে লাউ, কুমড়া, শিম, চিচিংগা, ঢেড়শ, পালং শাক, লালশাক, বরবটি, ডাটা সহ নানান ধরনের সবজি চাষ শুরু করেন। তবে সেখানে লাভ বেশী হতো না বলে জানান কৃষক শহর আলী। কারন বাজার থেকে বীজ, সার ঔষধ কিনে ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে যেত। তাছাড়া উৎপাদিত পন্যের বাজার মুল্যও কম ছিলো। তিনি বলেন “কৃষি কামে লাভের মুখ দেখছি বারসিক এর পরামর্শের কারণে। বারসিক এর পরামর্শে ২০১৩ সাল থেইক্যা আমি জৈব কৃষি চর্চা শুরু করছি। অহন আমার অনেক লাভ হয়। তাছাড়া বারসিক হাত ধইরা আমি সরাসরি ঢাকার বাজারে আমার ফসল বিক্রি করার সুযোগ পাইছি।”
২০১৩ সালে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক নয়াবাড়ি আদর্শ গ্রামের কৃষক কৃষাণিদের নিয়ে সংগঠন তৈরি করে। প্রশিক্ষণ প্রদান করেন স্থায়ীত্বশীল কৃষি বিষয়ে। নয়াবাড়ি কৃষক সংগঠনের সদস্যদের শেখানো নিজে হাতে বীজ রাখার কৌশল, জৈব সার ও জৈব বালাই নাশাক তৈরি কৌশল। জৈব উপায়ে উৎপাদিত পণ্যের লাভজনক মুল্য পাপ্তিতে স্থানীয় বায়রা বাজারে আলাদা কর্নারের ব্যবস্থা করে। পরিচিত হতে থাকেন শহর আলী সহ এলাকার নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনকারী কৃষক কৃষাণিগণ। ২০১৪ সালে বারসিক ‘ঢাকা প্রাকৃতিক কৃষি বিপনন কেন্দ্রের’ সাথে যুক্ত করেন এলাকার সকল নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনকারী কৃষকদের। তাদের নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন প্রসংশা পায় সিংগাইর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় কৃষি বিভাগ। সম্প্রতি কৃষি বিভাগের সহায়তায় শহর আলী সরকারী উদ্যোগে পরিচালিত ‘কৃষকের বাজারে ’ নিরাপদ পন্য বিক্রয়ের নেতৃত্ব প্রদান করছেন। তার নেতৃত্বে গ্রামের রাহেলা বেগম, হাচান, জয়তুন বেগম, আকবর মোল্লা, কমলা বেগম সহ বেশ কিছু কৃষক সপ্তাহে দুই দিন পন্য বিক্রি করে অর্থ আয় করতে পারছেন।
কৃষক শহর আলী মনে করেন খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্নতা অর্জন করেছে। তবে নিরাপদ খাদ্যের সংকট তৈরি হয়েছে। তাই খাদ্য উৎপাদানের পাশাপাশি খাদ্যের গুনগত মানের দিকে নজর দেওয়া জরুরী। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার জৈব কৃষি নীতিমালা তৈরি করেছে। এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে কৃষি বিভাগের কর্মতৎপরতাও বেড়েছে আগের চেয়ে। তবে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও সম্প্রসারণে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগ যেমন বাড়াতে হবে, সেই সাথে এগিয়ে আসতে হবে দেশের সকল পর্যায়ের কৃষকদেরও।