আমরাও তো মানুষ
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল:
পৃথিবীতে বসবাসরত প্রত্যেক পেশার মানুষ প্রত্যেকে আলাদা আলাদা গুণের অধিকারী। সকল পেশাজীবী তাদের নিজের সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে থাকে। প্রত্যেকের সাংস্কৃতি প্রত্যেকের আলাদা পরিচয় বহন করে। সে পরিচয়ে নিজ পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ ও দেশের উন্নয়নে নানান ভূমিকা রাখছে। কোন পেশায় ছোট না। প্রত্যেক পেশাজীবী মানুষ প্রত্যেক পেশাজীবীর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। একটিকেও বাদ দিয়ে আমরা চলতে পারিনা। যত নিচু পেশার হোক না কেন আমাদের প্রতিদিনকার জীবনধারণের জন্য তাদের অবদান কোন অংশেই কম নয়। প্রত্যেক পেশার মানুষ যেন আমাদের জীবনযাপনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় এবং সুন্দর করার জন্য নানান ভূমিকা রাখছে। প্রত্যেক পেশাকে সমান গুরুত্ব দেবো, তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা হোক আমরা বিভিন্ন জায়গায় কথা বলার সময় এসব বিষয়ে অনেক কিছু বলি, উপদেশ ও পরামর্শ দিই। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি এবং স্থান কাল পাত্র ভেদে আমরা কতজনেই বা তা মনে রাখি বা পালন করি। আমরা পেশাজীবীদের অধিকার রক্ষায় তাদের পাশে থাকার নানান কথা বলি। কিন্তু এখনই অনেক পেশাজীবী তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাদেরকে ছোট করে দেখা হয়। তারা প্রতি পদে পদে লাঞ্চিত হচ্ছেন। সমাজে ও রাষ্ট্রে এই মানুষেরা যেসকলঅবদান রেখে চলেছেন আমরা সেসব সুবিধা ভোগ করি ঠিকই কিন্তু তাদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়ার সময় কাপর্ণ্য বোধ করি। এটাই কি আমাদের শিক্ষা। আমরা তো মানুষ। সৃষ্টির সেবা জীব হিসেবে দাবি করি। সেই জায়গা থেকে প্রত্যেক বর্ণ, ধর্ম, শ্রেণী ও পেশার মানুষকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করা আমাদের প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হওয়া উচিৎ। প্রত্যেক পেশার মানুষের কাছে আমরা ঋণী। সে জায়গা থেকে দরকার প্রত্যেক পেশার উপর সমমর্যাদা, সহানুভূতি ও ভালোবাসা।
বারসিক দীর্ঘদিন ধরে ভিন্ন ভিন্ন এলাকার মানুষকে তাদের উদ্যোগ ও শক্তিকে জানা এবং পারস্পারিক সর্ম্পকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে। সাথে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা, সুযোগ, সম্ভাবনাকে বিবেচনা করে উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। সমাজের সকল শ্রেণী, পেশা ও বিভিন্ন মানুষকে সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ তৈরির মাধ্যমে বহুত্ববাদী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় পেশাজীবী জনগোষ্টীর সমস্যা, সম্ভাবনা বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে দেখার চেষ্টা করছে। বিগত সময়ে মাঠ পর্যবেক্ষণে এবং তথ্য সংগ্রহে কাহার, ঋষি ও পরামাণিক সম্প্রদাযের জনগোষ্ঠীর সাথে আলোচনায় তারা বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তাদের পিছিয়ে পড়ার কথা জানান।
গত অক্টোবর ও নভেম্বর ইশ্বরীপুর ইউনিয়নের ইশ্বরীপুর গ্রামের ঋষি পরিবার এবং শ্যামনগর সদর ইউনিয়নের বাদঘাটা গ্রামের কাহার ও পরামাণিক সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর সাথে একক এবং দলীয়ভাবে আলোচনা হয়। আলোচনায় বর্তমান সময়ে তাদের অবস্থান, পেশাগত সমস্যা, সরকারি ও বেসরকারি সুযোগ সুবিধা, এবং বিভিন্ন ভাতাদি প্রাপ্তির সমস্যা বিষয়গুলো গুরুত্ব দেওয়া হয়।
অংশগ্রহণকারী প্রবীণ নীলকান্দ দাস ও পাচি দাসী বলেন, ‘বর্তমানে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে আছি আমরা। আমাদের পেশার কাজ হলো বাঁশ বেতের উপকরণ তৈরি, চুল কাটা, জুতা ও ব্যাগ সেলাই ও তৈরি, গোলা তৈরি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান-বাজনা করা এরকম নানান ধরনের কাজের সাথে আমরা যুক্ত। বর্তমান করোনার সময় কাজগুলো ঢিলেঢালা হয়ে গেছে। আমাদের কাজ কর্মে বাধা তৈরি হয়। সেখান থেকে বের হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছি। এ পেশায় থেকে কিন্তু আমাদের খুব বেশি আয় রোজগার হয় তাও নয়। কোন রকমে চলে যায়। বাপ দাদাদের ঐতিহ্য তাদের পেশা ও কাজকে জীবনের সম্বল করে নিয়ে চলেছি। আমাদের ছেলে মেয়েরাও স্কুল কলেজে খুব বেশি যায় না। বিভিন্ন মানুষের কাছে আমাদের এই পেশার কাজকে নিয়ে যাই এটা আমাদের খুব ভালো লাগে। আমরা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এখানে অনেক বয়স্ক লোক আছে তাদের কোন কার্ড নেই। বিভিন্ন দুর্যোগ হয়ে গেলেও আমরা যারা দিন আনি দিন খাই আমরা কোন সুযোগ-সুবিধা পাইনা। কোন কাজ নিয়ে কোন প্রতিষ্ঠানে গেলে তাও মেটে না। অনেক সময় যেয়ে যেয়ে আমরা যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছি। নিজেরা যা আয় রোজগার করি তা দিয়ে চলার চেষ্টা করি।’
বাদঘাটা গ্রামের ৮৩ বছর বয়সের প্রবীণ নারী জোসনা সরকার আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার স্বামী মারা যায় এখান থেকে ৩৫ বছর আগে। সেই সময় থেকে শিশু কার্ড, ভিজিডি কার্ড, বিধবা ভাতার কার্ড তৈরির জন্য যোগাযোগ করতে থাকি। সেখান থেকে গত পাঁচ বছর আগে এসে এই বয়সে বয়স্ক ভাতার কার্ড পাই। স্বামী মারা যাওয়ার পরে খুব কষ্ট করে ছেলে মেয়েদের মানুষ করেছি। সেই সময় যদি আমার এই কার্ডটি হতো অনেক উপকার হতো। সরকারি-বেসরকারি কেউ আমাদের দিকে তাকায় না। আমরাও তো মানুষ। আমাদের তো কিছু চাহিদা থাকতে পারে। সেটা কাকে বলবো, আর কেবা শুনবে।’
অন্য অংশগ্রহণকারী, কুটেরাম দাস, কার্তিক সরকার পাচি দাসী, লাবণ্য সরকাররা জানান, তাদের কাজ ও পেশাকে মানুষ শ্রদ্ধা করে না। তা না হলে কেন কোন প্রতিষ্ঠান তাদের এখানে আসেনা। তাদের সমস্যার কথা বললে কেউ শোনেনা। খুবই কষ্ট করে এবং বছরের পর বছর যোগাযোগের পরে কিছু কার্ড পেয়েছেন তারা। কিন্তু কার্ডে যে সহায়তা পান তা বর্তমান বাজার পরিস্থিতি এবং দ্রব্য মূল্যের তুলনায় খুবই কম। তারা মনে করেন, মাসের ভাতা মাসে প্রদান এবং তা সহজে পাওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত।