স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অচাষকৃত উদ্ভিদের ব্যবহার

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
খাবার খেলে যে শুধু পেট ভরে তাই নয়, কিছু খাবার শরীরের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে। আবার কোনো কোনো খাবার শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলের রাস্তার ধারে, বাড়ির আঙিনায় অনেক নাম না জানা উদ্ভিদ চোখে পড়ে। সকলেই হয়তো এসব উদ্ভিদের ব্যবহার জানেন না। কিন্তু যারা জানেন, তাঁরা প্রতিদিন এগুলো খাবার বা ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন।
দেশের এই করোনাকালীন সময়ে সকল স্তরের মানুষ বিভিন্ন খাদ্য চর্চার মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছেন। সেই চেষ্টায় পিছিয়ে নেই আমাদের গ্রামীণ নারীরাও। তাঁরা নিজেদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও চর্চাকে কাজে লাগিয়ে অচাষকৃত উদ্ভিদ ব্যবহার করে নিজে ও পরিবারের মানুষদের সুস্থ রাখার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের দরুন হাসামপুর গ্রামের কৃষাণী হোসনা আক্তার। বাড়িতে টেলিভিশন নেই। আমাদের দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর নিজেদের মধ্যে আলোচনা, স্বাস্থ্যকর্মী ও বারসিক’র সহযোগিতায় তিনি এই রোগ সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। রোগের লক্ষণ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কেও ভালোভাবে জেনেছেন। এই রোগ প্রতিরোধ করতে হলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হয় এবং বিশেষ কিছু খাবার খেতে হয়। তখন থেকেই তিনি তাঁর পরিবারের জন্য প্রতিদিন অচাষকৃত উদ্ভিদসহ নানা ধরণের গৃহস্থালী উপকরণ দিয়ে করোনা প্রতিরোধক খাবার তৈরি করে আসছেন।
তিনি জেনেছিলেন শরীরের রক্ত পরিষ্কার থাকলে মানুষের তেমন কোনো অসুখ হয়না। ছোটবেলায় দাদীর কাছে শুনেছিলেন টুনিমানকন (থানকুনি) পাতার রস রক্ত পরিষ্কার করা ছাড়াও আমাশয়, জ্বর, শরীরের দূর্বলতা কমাতে সাহায্য করে। তাঁর বাড়ির উঠানে সব্জী বাগান আছে। সেখানের পরিষ্কার জায়গায় প্রচুর থানকুনি জন্মে। তিনি প্রতিদিন সকালে বাগান থেকে গোড়াসহ টুনিমানকন এর পাতা তুলে নিয়ে আসেন এবং ছেঁচে রস বের করেন। দুই চামচ পরিমাণ রস পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খেতে দেন। তাঁর এই চর্চা এখনো অব্যাহত আছে। ফলে তাঁর পরিবারের সকলেই সুস্থ আছেন।
দূর্বা ঘাসের রস শরীরে কোথাও কেটে গেলে রক্ত পড়া বন্ধ করে। আবার শরীরের দূর্বলতা দূর করার পাশাপাশি রক্ত বৃদ্ধি করে। তিনি প্রতিদিন এক কাপ পরিমাণ দূর্বা ঘাসের রস করে পরিবারের সবাইকে সকালে খালি পেটে খেতে দিয়েছেন। এভাবে মাত্র ৮-১০ দিন এটি ব্যবহার করেছেন। তাঁর পরামর্শমতো সংগঠনের অনেক সদস্যই দূর্বার রস খেয়েছেন।
এগুলো ছাড়াও তিনি প্রতিদিন সকাল বিকাল আদা, তেজপাতা, লং, এলাচ, দারুচিনি ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহার করে চা তৈরি করে খাচ্ছেন। গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে দুবেলা কুলকুচা করে যাচ্ছেন। নিজের বাড়িতে অনেক লেবু গাছ আছে। লেবু দিয়ে চা তৈরি করেও খাচ্ছেন নিয়মিত। বারবার পানি গরম করার ঝামেলা কমাতে বড় একটি ডেকচিতে পানি ভরে সব সময় চুলায় বসিয়ে রাখেন। পরিবারের সদস্যরা বারেবারে সেই পানি খান।


শুধু নিজেদের সুস্থতার প্রতি খেয়াল রাখেননি তিনি। নিজের সংগঠনের সদস্যদেরও এ বিষয়ে সচেতন করে তুলেছেন। নিজের গাছ থেকে লেবু দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। এছাড়া বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, পরিধেয় কাপড় কাচা, অন্যদের সাথে নিরাপদ দুরত্বে থেকে কথা বলা ইত্যাদিও এই সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে চলমান আছে। এর পাশাপাশি প্রতিদিনই কোনো না কোনো অচাষকৃত উদ্ভিদ যেমন তেলাকুচা পাতা, হেলেঞ্চা, খুইরা, ঘৃত্তিকাঞ্চন, কচু ইত্যাদি সংগ্রহ করে শাক হিসেবে রান্না করে খাচ্ছেন। এ সমস্ত উদ্ভিদের অনেক পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতার মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে যথেষ্ট সহায়ক।
এই সময়ে শরীরকে সুস্থ রাখতে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হোসনা আক্তার ও সংগঠনের সদস্যরা প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত উপকরণ নিয়মিত ব্যবহার করছেন এবং সংগঠনের সদস্যদের পরিবারের সবাই সব ধরণের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কারণে সকলেই সুস্থ আছেন। এখন পর্যন্ত কেউ কোনো অসুখে আক্রান্ত হননি।
গ্রামীণ জনগোষ্ঠী সারাবছরই নানা ধরণের অচাষকৃত উদ্ভিদ ব্যবহার করেন। কিছু উদ্ভিদ খাবার হিসেবে ব্যবহার করলেও এগুলো ঔষধি ভূমিকা পালন করে। নিজেদের সুস্থ রাখার জন্য এবং করোনা ভাইরাস মোকাবেলা করতে তাঁরা এই অচাষকৃত উদ্ভিদের নানা রকম ব্যবহার অব্যহত রেখেছেন এবং সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন।

happy wheels 2

Comments