দেপালের কপাল খুলেছে লাউ চাষে

:: দেবদাস মজুমদার, বিশেষ প্রতিনিধি, উপকূল অঞ্চল

দেপালের কপাল খুলেছে লাউ চাষেনিজের চাষের জমি নেই। নিজ জমি বলতে কেবল বসতভিটে। বাধ্য হয়ে অন্যের জমিতে কৃষি শ্রমিকের কাজ করা। চার সদস্যের পরিবারের ভরণ পোষণ চালিয়ে দুই সন্তানের পড়াশুনা করানো কঠিন ছিল তাঁর পক্ষে। প্রান্তিক কৃষক দেপাল চন্দ্র হাওলাদার (৪০) তবু দমে যাননি! নিচু কৃষিজমির জলাবদ্ধতা লেগেই থাকে। সেই সাথে জমিতে লবণের আগ্রাসন তো আছেই। জমির ফসল মার খায়। বর্গাচাষে সুফল আসে না। দেপালের মত উপকূলের কৃষকের আবাদে নানান সংকট। জমির জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার আগ্রাসন কাটিয়ে ওঠা দুরুহ।

ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য বিপর্যস্ত দেপাল কৃষিজমি বন্ধকী নেন। সেই জমিতে কান্দি/বেড় কেটে জমি উঁচু করে লাউ চাষ আর মৌসুমী নানা সবজি চাষ করে সুফল পান। এরপর থেকে শুরু হয় একে একে সামনে এগিয়ে চলা। ৬৬ শতাংশ জলাবদ্ধ কৃষি জমি ১৫ হাজার টাকায় এক বছরের বন্ধকী নিয়ে এভাবে চাষাবাদ করে চলেছেন তিনি গত ১৫ বছর ধরে। প্রতিবছর এক মৌসুমে লাউ ও নানা  শাকসবজি আবাদ করে তিনি প্রায় দেড় লাখ টাকা আয় করে থাকেন। অথচ জলাবদ্ধ ওই জমিতে ধান চাষে ১০ হাজার টাকারও ফসল ওঠে না।

উপকূলীয় পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার গুলিসাখালী ইউনিয়নের পূর্ব কবুতরখালী গ্রামের প্রান্তিক কৃষক দেপাল চন্দ্র হাওলাদার গত ১৫ বছর ধরে জৈব পদ্ধতিতে পরিকল্পিত লাউ চাষ করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। দেপালের এ সফলতা দেখে গ্রামের আরও পাঁচজন কৃষক কান্দি/বেড় পদ্ধতি অনুসরণ করে করে লাউ ও সবজি চাষে সফল হচ্ছেন। প্রান্তিক চাষী দেপাল এখন পূর্ব কবুতরখালী গ্রামের একজন মডেল চাষী।

সম্প্রতি মঠবাড়িয়া উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দুরে পূর্ব কবুতরখালী গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ৬৬ শতাংশ জমিজুড়ে দেপালের লাউয়ের বিশালকৃতির মাচান। মাচানে লাউয়ের ডগায় ফুল আর কচি লাউয়ের সমারোহ। কৃষক দেপাল ভরদুপরে লাউয়ের মাচান পরিচর্যায় ব্যস্ত। তিনি জানান, নিজের চাষযোগ্য জমি না থাকায় আজন্ম তাঁকে পরের জমিতে কামলা খাটতে হয়েছে। গত ১৫ বছর আগে ৬৬ শতাংশ জলাবদ্ধ কৃষিজমি ১৫ হাজার টাকায় এক বছরের বন্ধকী নেন। জলাবদ্ধ ও লবণের আগ্রাসনে এ জমি বছর বছর অনেকটাই পতিত থাকত। নীচু জমিতে বেড় কেটে লাউ ও মৌসুমী সবজি আবাদ শুরু করেন। এছাড়া আরও ৬৬ শতাংশ জমিতে শুরু করেন একই পদ্ধতি অনুসরণ করে কলা চাষ।

devdas-pic-3 (1)জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেই দেপাল সুফল পাচ্ছেন। তিনি জানান, মৌসুমের শুরুতে এ পর্যন্ত তাঁর লাউ ক্ষেত থেকে ৩০ হাজার টাকা রোজগার হয়েছে। এ বছর আবহাওয়া চাষের অনুকুলে থাকায় লাউয়ের ফলন আশাতীত হবে বলে তাঁর ধারণা। এতে তিনি আরও অন্তত দেড় লাখ টাকা আয় করবেন বলে আশা করছেন। জৈব পদ্ধতিতে লাউ ও অন্যান্য শাকসবজি আবাদ করে প্রান্তিক কৃষক দেপাল এর এখন সমৃদ্ধ এসেছে। তাঁকে অনুসরণ করে পূর্ব কবুতরখালী গ্রামের সুখ রঞ্জন গোমস্তা, মৃতোষ হালদার, সুনীল হাওলাদার, সুজন বিশ্বাস, সুনীল কুলুসহ আর অনেক কৃষক এমন আবাদ শুরু করে সফলতার মুখ দেখছেন। এসব কৃষক তাঁদের লোকায়ত জ্ঞানে ধান চাষের পাশাপাশি মৌসুমী নানান শাক ও সবজি আবাদে দেখছেন সমৃদ্ধির আলো।

এই প্রসঙ্গে দেপাল বলেন, নিজের জমি না থাকলেও আমি সমৃদ্ধ কৃষক। প্রতিবছর এ মৌসুমে আমি লাউ চাষে ও নানান শাকসবজি আবাদ করে প্রায় দেড় লাখ টাকা আয় করি। কলা চাষে বছরজুড়েই আরও কিছু আয় হয় আমার। অথচ জলাবদ্ধ এসব জমিতে ধান চাষে ১০ হাজার টাকারও ফসল উঠত না!  আমার নিজের পরিবারের ভরণ পোষণে এখন কারও কাছে হাত পাততে হয় না। আমি নিজে দুজন কৃষি শ্রমিকের কর্মসংস্থানও করতে পারছি। মেয়ে স্বর্ণ হাওলাদার ৮ম শ্রেণীতে এবং ছেলে জয় হাওলাদার দ্বিতীয় শ্রেণীতে লেখাপড়া করছে। তিনি আরও বলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আগামীতে আরও বড় পরিসরে মৌসুমী শাক ও সবজির প্লট তৈরি করবো।

এ বিষয়ে মঠবাড়িয়া উপজেলার গুলিসাখালী কৃষি ব্লকের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হরষিত চন্দ্র কীর্তুনীয়া বলেন, দেপাল একজন সফল চাষী। তাঁর মৌসুমী শাকসবজি আবাদে কৃষিবিভাগ মাঝে মাঝে পরামর্শ ও তথ্য প্রযুক্তিগত সহযোগিতা করে আসছে। তাঁকে অনুসরণ করে এলাকার অনেক চাষী আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।

happy wheels 2

Comments