কীটনাশক মানুষের শরীরে ক্যানসার রোগ সৃষ্টি করে
:: সিলভানুস লামিন
কৃষি ও ক্যান্সার
এটা ঠিক যে, কৃষি থেকে আমরা খাদ্যসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপাদান পেয়ে থাকি। তবে কীটনাশকসহ বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের নির্বিচার ব্যবহার ও প্রয়োগের কারণে সম্প্রতি কৃষিকে একটি অন্যতম বিপজ্জনক খাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Bureau of Labor Statistics এর মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষিকাজের সাথে জড়িত মানুষেরা যন্ত্র ও যান্ত্রিক উপকরণ ব্যবহার, সার্বক্ষণিক গবাদিপশুগুলো সংস্পর্শে আসা, অনবরত কায়িকশ্রম এবং রাসায়নিক সার, কীটনাশকের সংস্পর্শে আসার কারণে তারা খুব সহজেই বিভিন্ন রোগবালাইয়ের শিকার হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে কৃষি জনগোষ্ঠীরা Non-hodgkin’s Lymphomas, Multiple Myeloma, soft-tissue Sarcoma লিউকেমিয়া এবং চর্ম, মস্তিষ্ক, ফুসফুস ক্যান্সার ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয় মূলত কীটনাশক, রাসায়নিক সার, নাইট্রেট, ধুলা, জ্বালানি, যান্ত্রিক উচ্ছ্বিষ্ট ইত্যাদির সংস্পর্শে আসার কারণে। যদিওবা কৃষকরা কৃষি সংশ্লিষ্ট অন্য বিভিন্ন উপাদানের সাথে প্রতিনিয়ত সংস্পর্শতায় রয়েছে তথাপি ক্যান্সার ঝুঁকি মূলত কীটনাশকের ব্যবহার কারণে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। International Agency for Research on Cancer (IARC) প্রায় ১৬৫টি রেজিস্টার্ড রাসায়নিক কীটনাশক চিহ্নিত করেছে যেগুলোতে মানব ক্যান্সার সৃষ্টি করে এমন উপাদান রয়েছে। কিন্তু এসব রেজিষ্টার্ড রাসায়নিক কীটনাশকগুলোর মধ্যে নামেমাত্র কয়েকটির ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। অনেকগুলো গবেষণায় বলা হয় যে, শিশু এবং বয়স্ক মানুষেরা কীটনাশকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবের কারণে তাদের ক্যান্সার ঝূঁকি বেড়েছে। তবে অদৃশ্য কারণে মানব ক্যান্সার সৃষ্টি বা ঝূঁকি তৈরি করতে পারে এমন কীটনাশক এবং এদের ব্যবহার আইনগতভাবে নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত করার মতো উল্লেখ্যযোগ্য উদাহরণ ও অগ্রগতি চোখে পড়ে না।
অন্যদিকে কীটনাশক ছাড়াও তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য ক্যান্সার ঝুঁকি বাড়ায় তা বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে। তবে কীটনাশকের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত প্রমাণ না থাকায় যেসব কীটনাশক মানব ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় সেগুলো দেদারসে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে এটাও ঠিক যে, ক্যান্সার কিন্তু শুধুমাত্র একটি প্রভাবকের কারণে সৃষ্টি হয় না; এই রোগ জন্মের পেছনে অনেকগুলো কারণ বিদ্যমান। এসব কারণগুলোর সমন্বিত প্রভাবের ফলেই ক্যান্সার রোগটি সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানীরা অত্যন্ত ছয়টি উপাদান আবিষ্কার করেছেন যেগুলো ক্যান্সার রোগ সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। তার মধ্যে কীটনাশক হচ্ছে অন্যতম উপাদান। প্রাণী বিষয়ক গবেষণায় বলা হয়েছে, কীটনাশক বিভিন্নভাবে ক্যান্সার রোগ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে; তার মধ্যে জীনের বিষক্রিয়া, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করা, হরমোন কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি, টিউমার হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই রোগ সৃষ্টিতে কীটনাশক ভূমিকা রাখতে পারে। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধুমাত্র বিভিন্ন উপাদান ও উপকরণের সংস্পর্শে আসা নয়; বরং সংস্পর্শে আসার সময়টিও ক্যান্সার ঝুঁকি বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখে। ভ্রুণ অবস্থা থেকে বয়সন্ধিকাল পর্যন্ত কোষ বৃদ্ধি ও দৈহিক গঠনের সময় ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে বিভিন্ন উপাদান ও উপকরণের সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে একজন মানুষের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। জরায়ুতে থাকা অবস্থায় কোনও নারী যদি ক্যান্সার সৃষ্টি করে এমন উপাদানের সংস্পর্শে আসেন আসে তাহলে তার শিশুটির ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। ক্যান্সার সৃষ্টিকারী একক প্রভাবকটি কিন্তু বহুমুখী প্রভাবকের কার্যকারণের সাথে সক্রিয়ভাবে প্রবাহিত হয়।
কৃষিখাতে পরোক্ষভাবে জড়িতরাও ক্যান্সার ঝুঁকিতে আছে
কৃষি হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম একটি বৃহৎ খাত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৭ সালের হিসেব অনুযায়ী, মোট ২ মিলিয়ন মানুষ প্রত্যক্ষভাবে কৃষির সাথে জড়িত। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তারা অনেক সময় রাসায়নিক কীটনাশক এবং কারখানা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের সংস্পর্শতায় চলে আসে; যা তাদের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকিকে অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। কথা হলো, প্রত্যক্ষভাবে যারা এই খাতের সাথে জড়িত কেবল তারা নয় বরং তাদের ছেলেমেয়ে ও অন্যান্য পরিবার সদস্যরাও কোন না কোন সময়ে এই পেশার সাথে জড়িয়ে পড়ে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে চলে আসে। ২০০৬ সালে একটি গবেষণা অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষক জনগোষ্ঠীর ৫০% ছেলেমেয়ে; যাদের বয়স ২০ বছরের নীচে কৃষি কাজের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং অতিরিক্ত আরও ৩ লাখ ৭ হাজার কিশোর-কিশোরী ভাড়া শ্রমিক হিসেবে কৃষিক্ষেত্রে কাজ করে। National Cancer Institute’s Agriculture Health ’র গবেষণা মতে, যেসব পরিবার কীটনাশক প্রয়োগ সংক্রান্ত কাজ করে এদের ২১ ভাগের আবাসস্থল কীটনাশক মেশানো হয় এমন জায়গা থেকে মাত্র ৫০ ফুট দুরত্বে রয়েছে, ২৭ ভাগ তাদের নিজেদের ঘরে কীটনাশক রাখেন এবং ৯৪ ভাগ কীটনাশক ছিটানোর সময় তাদের পরিধেয় পোশাক পরিবারের একই লন্ড্রিতে পরিষ্কার করেন। এছাড়া এই গবেষণায় আরও বলা হয়, ৫১% কীটনাশক ছিটানোর সাথে জড়িত কৃষকদের স্ত্রী কৃষি মাঠে কাজ করে। এর মধ্যে ৪০% কীটনাশক মিশ্রণ ও ছিটানোর কাজের সাথে সরাসরি জড়িত এবং এদের মধ্যে ৪৬% এই কাজটি গত ১০ বছর ধরে করে আসছেন।
অন্যদিকে যেসব মানুষ কৃষি মাঠের কাছে বসবাস করে বাতাসের মাধ্যমে তারাও পরোক্ষভাবে কীটনাশকের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্প্রতি একটা গবেষণায় বলা হয়, যেসব গর্ভবতী মহিলা কৃষিক্ষেতের কাছাকাছি বসবাস করে অন্যান্য গর্ভবতী মহিলার চেয়ে তারা ২.৫ গুণ বেশি মূত্রজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হয়। ২০ বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ মিলিয়ন মানুষ কীটনাশক ও রাসায়নিক সারে ব্যবহৃত নাইট্রেট-এ দূষিত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করতো। এই গবেষণাগুলোতে অবশ্য আরও বলা হয়, কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত কীটনাশক ও অন্যান্য রাসায়নিক উপকরণের প্রভাবে কৃষিমাঠ তো বটেই; এই দূষণ কয়েক মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে ধুলাস্তরে যে পর্যায়ের কীটনাশক থাকে তা ঘরের ভেতরের বায়ুস্তরের তুলনায় ১০ থেকে ২০০ গুণ বেশি। গবেষণাগুলোতে বলা হয়েছে, সাধারণ কৃষিশ্রমিকের তুলনায় অভিবাসী শ্রমিকরা সবচে’ বেশি ক্যান্সার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ২০১১ সালের তথ্যানুযায়ূ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন মানুষ অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। এই শ্রমিক কৃষিক্ষেত্রে শস্য-ফসল উৎপাদনে মূল্যবান শ্রম বিনিয়োগ করে আসছে। এই সব শ্রমিক অনবরত কৃষিকাজ এবং তাদের আবাসস্থল কৃষিখামারের কাছাকাছি হওয়ার কারণে বেশির ভাগ সময়ে তারা কীটনাশকের সংস্পর্শে আসে। এছাড়া শিশুসদন না থাকায় তাদের ছেলেমেয়েরা অনেক সময় মা-বাবার সাথে কৃষিক্ষেতে সময় কাটায়। এসব শ্রমিকরা লিউকেমিয়াসহ লিবার, ফুসফুস এবং স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়।
ক্যান্সার ঝুঁকি বাড়ানো কীটনাশকগুলোকে নিষিদ্ধ করতে হবে
ব্যবহার বা প্রয়োগের পূর্বে যেকোন কীটনাশকের পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি মূল্যায়ন ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যে কোনও কোম্পানি তার উৎপাদিত কীটনাশক নিবন্ধনের পূর্বে এর পরিবেশগত, বিষক্রিয়া এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকটে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করতে হবে। তবে বিশ্বে বেশিরভাগ কীটনাশক আইন বা নীতিমালাগুলো প্রণীত হয়েছে মূলত Risk-Benefit ওপর ভিত্তি করে; মানব স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার ওপর ভিত্তি করে নয়। এক্ষেত্রে এই কীটনাশকটির অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশগত এবং এর উপকারিতার বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হবে। অন্যদিকে কোনও কীটনাশক বাজারে ছাড়ার সময় বা রেজিস্ট্রেশনের প্রয়োজনে বোতলের গায়ে কীটনাশকটির সক্রিয়সহ নিস্ক্রিয় উপাদানগুলোকে প্রকাশ করার শর্ত রাখতে হবে। কোম্পানিগুলো সাধারণত নিষ্ক্রিয় উপাদানটি লুকিয়ে রাখে বাণিজ্যিক গোপনীয়তার কারণে। বলা হয়, মানব ক্যান্সার সৃষ্টির পেছনে কীটনাশকগুলোর শুধুমাত্র সক্রিয় উপাদান নয় নিস্ক্রিয় উপাদানগুলোও সমান ভূমিকা রাখে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, Xylene বিশ্বের প্রায় ৯০০টি কীটনাশকের নিস্ক্রিয় উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে এই উপাদানটির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, এটি লিউকেমিয়া, মস্তিষ্ক ক্যান্সারসহ অন্যান্য রোগ তথা চোখ, গলা এবং নাকের ক্ষতি করে।
লেখায় ব্যবহৃত তথ্য www.healthandenvironment.org থেকে নেওয়া হয়েছে।