নানা পদের গাছ লাগাই ফল সবজি ঔষধ পাই

রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার
ভূমিকা
একটি বসতবাড়িতে নান পদের গাছ গাছালী থাকলে সেখান থেকে ফল, সবজি এমনকি ঔষধি গুনাগুণের নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। বিভিন্ন কারণে গ্রামেও বর্তমানে বাড়ির আশেপাশে পতিত জায়গায় পরিকল্পিতভাবে নানা পদের গাছ রোপণের প্রবণতা কমে যাচ্ছে। মানুষ হয়ে পড়ছে বাজারমূখী। এতে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্যতা যেমন কমছে তেমন কমছে প্রাণবৈচিত্র্যও। পাশাপাশি পারিবারিক পুষ্টি চাহিদার ক্ষেত্রেও ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। এতে প্রান্তিক মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ অবস্থায় পড়ছে। মানুষের বাজারমূখী হওয়ার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে সবজি, দেশি ফল ও কিছু ঔষধি গাছের বীজ বৈচিত্র্য। তবে আশার কথা এই যে, কিছু মানুষ নিজেদের কাজের মাধ্যমে এখনও টিকিয়ে রেখেছেন প্রাণবৈচিত্র্যর সমাহার। সেখান থেকেই তারা প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে তা দিয়ে পরিবারের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে থাকে। তেমনই একজন নারী হচ্ছেন রাজশাহী তানোর উপজেলার গোকুল-মোথুরা গ্রামের শ্যামলী রানী সূত্রধর (৫৫)। তিনি তার বসতবাড়িকে সাজিয়েছেন দেশি জাতের নানা পদের ফলজ, বনজ, ঔষধি গাছ, বৈচিত্র্যময় মৌসুমী সবজি, প্রয়োজনীয় অচাষকৃত শাকসবজির ভান্ডার দিয়ে।

শুরুর গল্প
বারসিক ২০১৪ সালে কাজ শুরুর করার মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষের সাথে জননেতৃত্বে উন্নয়নের যাত্রাও শুরু হয়। আস্তে আস্তে গ্রামটিতে “গোকুল-মোথুরা কৃষক সংগঠন” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা পায়। সংগঠনটি নিয়মিত নিজেদের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এলাকা উপযোগি ধানজাত নির্বাচন কার্যক্রম ও বর্ধন, মৌসুমী সবজির জাত বৈচিত্র্য বৃদ্ধি, জৈব পদ্ধতিতে ফসল চাষাবাদ, বীজ বাড়ি প্রতিষ্ঠা, সরকারি সুযোগ ও সুবিধা প্রাপ্তিতে কৃষকদের অগ্রগামী ভূমিকা রাখা ইত্যাদি। সেই সংগঠনের একজন সদস্য হয়ে শ্যামলী রানী অগ্রগামী নারী হয়ে এগিয়ে আসেন। বারসিক থেকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও সভার মাধ্যমে তিনি জেনেছেন প্রাণবৈচিত্র্য কিভাবে মানুষের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। সেখান থেকেই শুরু আস্তে আস্তে তিনি অন্য জনসংগঠন বরেন্দ্র বীজ ব্যাংকের মাধ্যমে নানা জাতের সবজি বীজ সংগ্রহ করে বাড়ির আঙ্গিনায় রোপণ করতে থাকে। তিনি যে বীজ বপন করতেন ফসল পরিপক্ক হলে সে বীজ ফসলের বীজ আবার নিজে সংরক্ষণ করে রাখতেন পরবর্তী মৌসুমে চাষ করার জন্য। এভাবেই শুরু শ্যামলী রানীর পরিবর্তনের গল্প।


তার বাড়িসহ বসতভিটার আয়তন ৩৩ শতাংশ। ফসলী জমি তেমন নেই। তিন সন্তান, স্বামী ও বিশেষভাবে সক্ষম একজন ননদ মিলিয়ে ছয় জনের সংসার তাঁর। ছেলেরা বিয়ে করার পর এখন সংসারের সদস্য সংখ্যা আটজন। ছেলেরা বাবার সাথে বর্গা নিয়ে চাষ করা জমিতে সহায়তা করেন। শ্যামলী রানী বলেন, “আট জনের সংসারের সকল খরচ শুধু বর্গা নেওয়া জমি চাষের মাধ্যমে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সে চিন্তা থেকে বারসিক’র সহায়তায় আমি আমার বাড়টিকে মৌসুমি সবজি বৈচিত্র্য দিয়ে সাজাতে পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। যাতে করে বাড়ির উৎপাদিত সবজি দিয়েই আমার খাওয়ার কাজ চলে বাজার থেকে যেন কিনতে না হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার বাড়িতে ২ জাতের লাউ, ৩ জাতের মিষ্টি কুমড়া, ৭ জাতের সীম, ৪ জাতের মরিচ, ৪ জাতের বেগুন, ২জাতের সজিনা, ৩ জাতের পুঁইশাক, ২জাতের শসা, ২ জাতের করলা, ৩ জাতের পেঁপে, ১৫ জাতের অচাষকৃত শাক, ২ জাতের পটল, ৩ জাতের কলা, ৬ জাতের আম, ৬ জাতের শাক ১০ জাতের ঔষধি গাছ, ৮ জাতের বনজ গাছ, ২ জাতের হলুদ, ১১ জাতের দেশি ফল গাছ নানা জাতের ফুল গাছ আছে। যেখান থেকে আমি কখন ফল, সবজি এবং কিছু রোগের ঔষধ পেয়ে থাকি। সর্দি কাশি হলে আমাদের পরিবারের সবাই তুলসি পাতা ও বাসক পাতার রস খাই সর্দি কাশি সেরে যায়।

জৈব চর্চা
শ্যামলী রানী নিজেই স্বামীর সহযোগিতা নিয়ে বাড়িতে গড়ে তুলেছেন ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন কেন্দ্র। সেখান থেকে যে সার উৎপাদন হয় তা দিয়েই বাড়ির আঙ্গিনায় চাষকৃত শাকসবজি চাষে ব্যবহার করেন। এরপর তা ব্যবহার করেন মাঠ ফসলের জমিতে। এছাড়া জৈব বালাই নাশক হিসেবে মেহগনির ফল, বিশকাটালির পাতা, মেহগনির পাতা, ছাই, নিম পাতার রস ব্যাবহার করেন সবজি চাষে তিনি এগুলো সম্পর্কে জেনেছেন বারসিক ও কৃষক সংগঠন আয়োজিত জৈব পদ্ধতিতে ফসল চাষাবাদ বিষয়ে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এ বিষয়ে শ্যামলী সূত্রধরের স্বামী শ্রী জিতেন্দ্রনাথ সূত্রধর (৬৫) বলেন, ‘বাড়িতে উৎপাদিত শাকসবজিতে কীটনাশক ব্যবহার করি না। কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ছাড়া সবজির স্বাদই আলাদা।

বিনিময় ও বিতরণ
দীর্ঘ ২ বছরের করেনাকাল কাটছে। করোনার সময় বাড়িতে উৎপাদিত সবজি, অচাষকৃত শাক, বীজ বিনিময় করেছেন প্রতিবেশিসহ গ্রামের অন্য পরিবার মিলিয়ে ৬০০ জনের মাঝেও। তিনি বলেন, ‘তখন অনেকে বাজারে যেত না বা তেমন টাকা পয়সা ছিলো না আমি তাঁদের সহযোগিতা করেছি।’ উৎপাদিত সবজির পাশাপাশি তিনি কখনও সবজির চারা ও বীজ সহযোগিতা করেছেন। তিনি একটি রেজিষ্টারে বীজ বিনিময়ের তালিকা করেছেন যেখানে দেখা গেল গত বছরে ৬৫০ জন কৃষক-কৃষাণীর মাঝে ২৯ ধরনের সবজি ও ফল বীজ বিনিময় করেছেন। এ বিষয়ে শ্যামলী রানী বলেন, ‘আমার যে বীজটা নেই কোথায় বেড়াতে গেলে বা প্রতিবেশিদের নিকট থেকে সবজি সংগ্রহ করে নিজে চাষ করি, আবার আমরা বীজ বিনিময় মেলার আয়োজন করি মৌসুমভিত্তিক। যেখান থেকেও আমরা জানতে পারি কার নিকট কি বীজ আছে বা আমাদের এলাকায় কয় ধরনের সবজি বীজ আছে। আমি সকলকে বেশি বেশি করে সবজি চাষের পরামর্শ দিই। যাতে বাজার থেকে আমাদের সবজি কিনতে না হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার এ কাজে সব সময় সহযোগিতা করেন আমার স্বামী। তার কারণেই আমার বাড়িটি আজ একটি সবুজে ভরে উঠেছে।’

উপসংহার
বসতভিটার সকল জায়গার পূর্ণ ব্যবহার করলে একটি পরিবারের বৈচিত্র্যময় সবজি চাহিদা পূরণ হয়। পাশাপাশি উৎপাদিত সবজির বাড়তি অংশ বিক্রয় করেও লাভবান হওয়া যায়। শ্যামলী রানীর মতো গ্রামের প্রান্তিক নারীরা নিজেদের কাজ দিয়ে প্রমাণ করেছেন করোনা মহামারীর মোকাবেলা করা যায় এবং প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে তাঁদের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

happy wheels 2

Comments