অনেক দুঃখের মাঝেও সোনালী ধান হাওরবাসীর মুখে ফোটায় মধুর হাসি
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
বাংলাদেশ একটি নদী মাতৃক কৃষি প্রধান দেশ। এ দেশটি মৌসুমী ঋতুর দেশও বলা হয়। এ দেশটিকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে ৩০টি কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এদেশের কোথাও সমতল, কোথাও গড়, কোথাও নদীবহুল, কোথাও পাহাড়, কোথায় উঁচু বরেন্দ্র এলাকা, কোথাও শুধু হাওর, কোথাও বাওর, কোথাও উপকূল, কোথাও বন। একেক এলাকার জনগোষ্ঠী একেক সংস্কৃতির ধারক। দেশের মোট ভূ-খন্ডের প্রায় ৬% হলো হাওর। অধিকাংশ হাওরই নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। হাওরবাসীদের অধিকাংশই কৃষক। বছরে মাত্র একটি মৌসুমে (বোরো) হাওরাঞ্চলে ধানের চাষ হয়। বেশিরভাগ সময় হাওরের কৃষি জমিগুলো পানির নিচে থাকায় চাষের অনুপযোগি থাকে। হাওরের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী বছরের বেশিরভাগ সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়ে জীবীকা নির্বাহ করেন। আবার বোরো ধান চাষের সময় হলে (নভেম্বর-মে) তারা হাওরে ফিরে এসে ধান চাষ করেন। তবে বোরো ধান ফসল ঘরে তোলা নির্ভর করে সম্পূর্ণই প্রকৃতির উপর। এক বছর ভালোভাবে ধান ঘরে তুলতে পারলেও অন্য বছরে সমস্ত ধান জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ-আগাম বন্যা, শিলা বৃষ্টি বা বিভিন্ন রোগের আক্রমণে ঘরে তোলা সম্ভব হয়না। ধান কেটে ঘরে না তোলা পর্যন্ত হাওরের সকল কৃষকদেরকে অজানা আশংকার মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হয়, কখন আগাম বন্যা বা পাহাড়ি ঢলের পানিতে আধা-পাকা ধান পানিতে তলিয়ে যায় বা কোন অজানা রোগে ধানের ফলনে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে।
হাওরাঞ্চলের অধিকাংশ কৃষকের পছন্দের ধানের জাত হলো ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯। হাওরের নিচু জমিতে ব্রি-২৮ এবং অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে কৃষকরা ব্রি-২৯ জাতের ধান চাষ করেন। কিন্তু এই দু’টি ধানের জন্মকাল অনেক বছর হওয়ায় এই জাতগুলোতে বিভিন্ন ধরণের রোগের সংক্রমণ হচ্ছে, যা’ কৃষকদের পক্ষে প্রতিরোধ করা কঠিন। বিশেষভাবে ব্লাস্ট রোগ (লিফ ব্লাস্ট, নট ব্লাস্ট, নেক ব্লাস্ট), কারেন্ট পোকার আক্রমণ ও আবহাওয়ার তারতম্যের ফলে (কোল্ড/হট ইঞ্জুরি) ফলে প্রতিবছর অনেক কৃষক ব্যাপক ক্ষতির সন্মূূখীন হচ্ছেন। বিগত বোরো মৌসুমগুলোতে (২০১৯, ২০২০, ২০২১) এসব রোগ ও পোকার আক্রমণে ধান চিটায় পরিণত হওয়ায় কৃষকরা হাওরের অনেক বোরো ধান না কেটে ফেলে রেখেছিলেন।
২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ বোরো মৌসুমে মদন উপজেলার তলার হাওর, গণেষের হাওর, জালিয়ার হাওর, ডিঙ্গাপোতা হাওরসহ বিভিন্ন হাওরের অনেক জমি ব্লাস্ট রোগ ও কারেন্ট পোকার আক্রমণে সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিষয়টি তৎকালীন উপজেলা কৃষি বিভাগের দৃষ্টি আর্কষণ করা হলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাগণ কৃষকদেরকে পরবর্তীতে ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ জাত চাষ না করে এ দু’টি জাতের বিকল্প হিসেবে ব্রি-৮৮ ও ব্রি-৮৯ জাত চাষ করার পরামর্শ দেন। কৃষি বিভাগের মতে, ব্রি-৮৮ ও ব্রি-৮৯ জাতটি ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ জাতের চেয়ে ফলন বেশি এবং সময়কালও ১০-১২ দিন কম। কিন্তু হাওরের কৃষকরা কৃষি বিভাগের এই পরামর্শে বিশ্বাস না করে প্রতিবছর ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ জাত করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আবার যারা কৃষি বিভাগের পরামর্শ মেনে ব্রি-৮৮ ও ব্রি-৮৯ জাত চাষ করতে আগ্রহী তারা বাজারে উক্ত জাতের বীজগুলো সময়মত এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে না পেয়ে ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ জাত চাষ করতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে অন্যান্য বোরো মৌসুমের ন্যায় ২০২২ বোরো মৌসুমেও ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ জাতের ধানে ব্লাস্ট রোগ ও কারেন্ট পোকার আক্রমনে ধানের শীষ চিটা হওয়ায় ফলন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধানের শীষ বের হবার মূহুর্তে নট ব্লাস্ট ও নেক ব্লাস্ট রোগ এবং কারেন্ট পোকার আক্রমণে ধানের সম্পূর্ণ শীষ মরে সাদা হয়ে যায়। অন্যদিকে হাওরে আগাম চাষকৃত ধানগুলো কাইচ থোর বা শীষ বের হবার কালে আবহাওয়ার তারতম্যের ফলে পুরোপুরি বের হতে পারেনা বা শিষে দানা হয়না।
তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবং কোন ধরণের প্রাকৃতিক বিপর্যয় না ঘটলে হাওরের কৃষকরা ভালোভাবেই ধান ফসল ঘরে তুলতে সক্ষম হয়। আর তখন হাওরবাসীদের আনন্দের সীমা থাকেনা। অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করলে হাওরের কৃষক পরিবারগুলোর সকল সদস্যরা এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে পুরো মে মাসজুড়ে ব্যস্ত থাকে ধান কাটা, মাড়াই, প্রক্রিয়াজাত করা, বিক্রি এবং খড় শুকানোর কাজে। এসময় হাওরের শিক্ষার্থী শিশু, কিশোর-কিশোরী ও যুবরাও স্কুল বন্ধ রেখে মা-বাবাকে ধান সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে সহায়তা করে। বয়স্ক নারী-পুরুষ ধান ও খড় শুকানোর কাজ করে এবং কর্মক্ষম পুরুষরা ধানকাটা, ধানের আটি বাড়ি আনা এবং ধানের বস্তা ঘরে তোলার কাজ করেন। নারীরা ধান উড়ানো (ঝাড়া), রোদে শুকানো এবং বস্তায় ভরার কাজসহ ঘরে তোলার কাজ করে। এসময় হাওরের অপেক্ষকৃত উঁচু জায়গাগুলোতে (খলা) নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী ও যুবদের কর্ম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। বোরো ধান ফসলকে কেন্দ্র করে হাওরের কৃষকরা তাদের পরিবারকে নিয়ে গোট বছরের পরিকল্পনা করে। ধান ফসল ঘরে তোলার পর হাওরবাসীদের হাতে অফুরন্ত সময়।
কিন্তু বোরো ধানকে নিয়ে হাওরের কৃষকদের এ স্বপ্নে ছায় ঢেলে দেয় ধান কেটে ঘরে তুলতে না পারার অজানা আশংকা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলেও কৃষি শ্রমিকের উচ্চ মজুরি, অধিক পরিবহন খরচ, সময়মত শ্রমিক বা হারভেস্টর না পাওয়ায় সময়মত ধান কেটে আনতে না পারায় ন্যায্য বাজার মূল্য থেকেও কৃষকরা বঞ্চিত হয়। চলতি বোরো মৌসুমে নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলা, সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে কয়েক হাজার জমির বোরো ধান পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। আবার অনেকে পানিতে অর্ধ ডুবা ধান শ্রমিকদের সাথে আধা-আধি চুক্তিতে কাটতে বাধ্য হয়েছে। তব হাওরের সমতল এলাকাগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় অনেক কৃষক দৈনিক শ্রমিক প্রতি ৮শ’ থেকে এক হাজার মজুরিতে ধান কাটছেন। আবার যাদের অনেক জমি তারা প্রতি ১৬টি আটির মধ্যে ৪টি শ্রমিকদের দেয়ার শর্তে ক্ষেত থেকে ধান কাটছেন। ফলে মোট উৎপাদনের এক চর্তুথাংশই ফসল কাটায় ব্যয় হচ্ছে। ধান পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ (মাড়াই, ঝাড়া, শুকানো, সংরক্ষণ) বাবদ এক অংশ এবং উৎপাদন খরচ বাবদ আরও এক অংশ ব্যয় হওয়ায় মাত্র এক অংশ থাকছে কৃষকদের ঘরে। আবার জলবায়ু পরিবর্তন জনিত দূর্যোগের ফলে (আগাম বন্যা, রোগ-বালাই, শিলাবৃষ্টি, ঝড়, হট/কোল্ড ইঞ্জুরি) অনেক কৃষক খরচের টাকাও তুলে আনতে পারছেনা। হাওরের অধিকাংশ কৃষকই বর্গা চাষি ও বন্ধকী চাষি। এ সকল চাষিরা দাদন নিয়ে, ঋণ-ধার করে বা কোন সম্পদের ক্ষতি করে অনেক আশা নিয়ে বোরো ধান চাষ করেন। এমন পরিবারে সুখের বদলে শোক নেমে আসে। তাই বোরো ধান চাষ হাওরবাসীর মনে আনন্দ ও সুখের হাসি ফোটালেও বেশিরভাগ সময় দুঃখই বয়ে আনে।
তাই হাওরের কৃষকদের সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় ধানের বীজ (ব্রি-৮৮, ব্রি-৮৯ ও হাওর উপযোগি অন্যান্য জাত) সময়মত ও পর্যাপ্ত পরিমাণে কৃষকদের জন্য সহজলভ্যকরণ, হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধগুলো আরও উঁচু ও মজবুতকরণ এবং হাওরের ফসল সহজে পরিবহনের জন্য হাওরের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগসমূহকে সাম্প্রতিক সময়ে হাওরের দূর্যোগের বিষয়টি মাথায় রেখে যাথা সময়ে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। আশা রাখি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে হাওরবাসীদের তথা কৃষকদের কল্যাণে অবদান রাখবে।
………