কৃষি ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে অর্পনা ঘাগ্রা:
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আমাদের দেশের কৃষিব্যবস্থার উপর। অকাল বৃষ্টি, অকাল বন্যা, তাপমাত্রার আধিক্য কৃষি ও জনজীবনে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। ফলে কৃষকও কৃষি ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছে। আর বাস্তবিক পরিস্থিতি থেকেই উপলব্ধি করছে ফসল উৎপাদনের নানমুখী চ্যালেঞ্জগুলো। কৃষি ক্ষেত্রে নতুন কর্মসংস্থানের পরিবর্তে সৃষ্টি হচ্ছে বেকারত্ব। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে অভিযোজন করার কৌশল তাদেরকে খুঁজতে হচ্ছে। খুঁজতে হচ্ছে সময় উপযোগি চাষাবাদ পদ্ধতি। বিগত বছর বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে কৃষকরা যেসকল সমস্যার সম্মুখিন হয়েছেন তারই কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হল।
কলমাকান্দা উপজেলার সদর ইউনিয়নের কাছাকাছি অধিকাংশ জমিতে প্রতি বছরই সরিষা চাষ করতে দেখা যায়। কিন্তু এই বছর পুরো জমিই ফাঁকা। এর কারণ হিসেবে চিনাহালা গ্রামের কৃষানি রেহানা আক্তার (৩৮) বলেন, “আশ্বিন মাসের শেষের দিকে আমরা সরিষা বুনতাম। কিন্তু এই বছর সরিষা বোনার সময়ই ঝড়, তুফান, বৃষ্টির কারনে বোনার সময় পার হইয়া গেছে। কার্তিক মাসেও বোনা যায়, কিন্তু এই সময় বুনলে নামিলা (দেরি) হয়, বীজ রাখা যায়না। কারণ তহন বোরো ধানের ক্ষেতের পানি আইসা যায়।”
নাজিরপুর ইউনিয়নের বেতুওয়া গ্রামের কৃষক মস্তু মিয়া (৮১) প্রায় ৭ বছর ধরে নার্সারি করেন। এই দীর্ঘ ৭ বছরে বর্ষাকালে তার নার্সারির কি ধরনের যতœ নিতে হবে তা তিনি খুব ভালভাবেই জানেন। কিন্তু এই বছর তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি বলেন, “এই বছরই আমি ভাদ্র মাসের শেষের দিকে বড় ঢল আইতে দেখলাম। আমি চিন্তা করিনাই এই সময় বড় ধরনের ঢল আইতে পারে। তাই পুকুরের মাছ- নার্সারি রক্ষা করার লাইগ্যা কিছু করার আগেই পুকুরের সব মাছ চইল্যা গেছে। আর প্রায় এক লক্ষ টাকার নার্সারির ক্ষতি হইছে।”
রংশিংপুর গ্রামের কৃষানি রীনা সরকার প্রতিবছরই শীত মৌসুমে বিভিন্ন জাতের শাক সবজি চাষ করেন। কিন্তু এই বছর তার শাক সবজি ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা তিনি লক্ষ করছেন। তিনি বলেন, “এই বছর রৌদ্রের তাপ অনেক বেশি। লাল শাকের পাতাগুলা পুইড়া যাইতাছে। লাউয়ের চারার কচি পাতাগুলাও পুইড়া যাইতাছে। ঠিকমত বাড়তাছেনা।” তিনি আরো বলেন, “আগে কুয়াশার লাইগ্যা মাটি ভিজা থাকতে দেখছি। কিন্তু এই বছর এমন সময়ও অনেক বেশি পানি দিতে হইতাছে। তারপরও রৌদ উঠলেই মাটি ফাইট্টা যাইতাছে।”
চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামের কৃষক সুকুমার হাজং প্রথমবারের মত পরীক্ষামূলক ভাবে তার ১৬ শতাংশ পরিমাণ বালু জমিতে মাসকালাই চাষ করে সফল হয়েছিলেন। তাই তিনি পরের বছরও মাসকালাই চাষ করার জন্য বীজও রেখেছিলেন। কিন্তু পরের বছর তার আর মাসকালাই চাষ করা হয়নি। এ সম্পর্কে তিনি জানান, “আমাদের এলাকায় আশ্বিন-কার্তিক মাসে মাসকালাই বুনতে হয়। কিন্তু গত বছর এই সময়ই ঝড় বৃষ্টি বেশী থাকাতে মাসকালাই বুনার সঠিক সময় আর ধরতে পারলামনা। আর আমার ঐ জমিটাও পতিত থাকলো।”
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কেবল কৃষিক্ষেত্রেই নয়, মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনেও প্রভাব ফেলতে শুরু করছে। এ সম্পর্কে রংশিংপুর গ্রামের সীমা রানী সরকার বলেন, “আগে শীতের সময় সারাদিন সবজি ক্ষেতে কাজ করতে পারছি। ইচ্ছা হইছে খালি রৌদ্রে থাকি। আর এইবার রৌদ্রের তাপে দুপুর পর্যন্ত কাজ করলেই শ্যামায় (ছায়া) গিয়া কয়েকবার জিরাইতে (বিশ্রাম) হয়।” তার মত অনেকেই অনুধাবন করছেন ঝড়, বৃষ্টি, বাদল, তাপমাত্রা আর পূর্বের অবস্থায় নেই। আর এই সবকিছুই হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।