বৈচিত্র্যময় শিম চাষে রোকসানার সাফল্য: লোকায়ত জ্ঞানের শক্তি
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
একজন আদর্শ কৃষক সব সময় নিজের জায়গার সুষ্ঠু ব্যবহার করতে জানেন। বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ, বীজ সংরক্ষণ ও গাছের পরিচর্যা তাঁর নিত্যদিনের অংশ। এই কৃষিকেই ঘিরে আবর্তিত হয় তাঁদের জীবন।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2025/02/IMG_20241229_111604_919@-1823142015.jpg)
নেত্রকোনার স্বরমশিয়া ইউনিয়নের সালকি মাটিকাটা গ্রামের রোকসানা আক্তার একজন উদ্যমী কৃষাণী। স্বামী ও এক সন্তান নিয়ে তাঁর ছোট পরিবার। স্বামী পেশায় একজন অটোচালক, তবে আয়ের অনিশ্চয়তা থাকায় সংসারে অভাব লেগেই থাকে। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে রোকসানা নিজ আগ্রহে বসতভিটায় সবজি চাষ শুরু করেন এবং পাশাপাশি গরু ও হাঁস পালন করেন।
শৈশব থেকেই কৃষিকাজের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। বাবার বাড়িতে কৃষিকাজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মাত্র ১৫ শতাংশ জমিতে তিনি পরিকল্পিতভাবে সবজি চাষ শুরু করেন। উঠোনজুড়ে স্থায়ী মাচায় শিম, লাউসহ নানা সবজি চাষ করেন। পুকুরপাড়ে পেঁপে, সুপারি, লেবু রোপণ করেছেন, আর পুকুরের একপাশে মরিচ, বেগুন, টমেটো ও হলুদ চাষ করে পরিবারের বার্ষিক মসলার চাহিদা মেটান।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2025/02/IMG_20250123_123413_149@828247158.jpg)
তিনি নিজেই কেঁচো কম্পোস্ট তৈরি করেন, যা তিনি রাজেন্দ্রপুর গ্রাম থেকে শিখে এসেছেন। প্রথম দিকে প্রতিবেশী ও বাবার বাড়ি থেকে বীজ সংগ্রহ করলেও এখন তিনি নিজেই বীজ সংরক্ষণ করেন। রাসায়নিক সার এড়িয়ে তিনি জৈব সার ও প্রাকৃতিক উপায়ে সবজি চাষ করেন।
প্রায় ৫-৬ বছর ধরে তিনি স্থানীয় জাতের শিম চাষ করে এলাকায় পরিচিতি লাভ করেছেন। তাঁর চাষকৃত শিমের মধ্যে আশ্বিনা ও পুইট্টা উল্লেখযোগ্য। গর্তের মধ্যে গৃহস্থালির আবর্জনা, মাছের আঁশ, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা রেখে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে তিনি চাষ করেন, যা মাটির উর্বরতা বাড়ায়। অঘ্রাণ থেকে চৈত্র পর্যন্ত শিম উৎপাদন করতে পারেন এবং মৌসুমের শুরু ও শেষের দিকে বেশি দামে বিক্রি করে লাভবান হন।
রোকসানার শিম চাষের সাফল্যের কারণে তাঁকে শিমবৈচিত্র্য গবেষণার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। বারসিকের সহায়তায় তিনি ছয়টি নতুন জাতের শিম ও তাঁর নিজস্ব তিনটি জাত নিয়ে গবেষণা করছেন। প্রতিটি শিমের জন্য আলাদা মাচা তৈরি করে চাষের প্রতিটি ধাপ লিপিবদ্ধ রাখছেন। তাঁর স্বামী ও ছেলে মাঝেমধ্যে তাঁকে সহযোগিতা করেন। তিনি আশ্বিনা, কাইক্যা, সাদা কাইক্যা, পুইট্টা, নলডুগ, হাতির কান, জামাইকুলি, গুতুম ও কার্ত্তিক জাতের শিম চাষ করছেন।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2025/02/1737617457655-1024x754.jpg)
গবেষণার অংশ হিসেবে তিনি শিম গাছের গোড়ায় কেঁচো কম্পোস্ট ব্যবহার করেন এবং পাতা হলুদ হওয়া রোধে বোর্দো মিশ্রণ প্রয়োগ করেন। বর্তমানে তাঁর প্রতিটি শিম গাছে ফলন হচ্ছে, যা বিক্রি করেও লাভবান হচ্ছেন। তাঁর সাফল্য দেখে অনেক কৃষাণী বীজ সংগ্রহের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
গ্রামবাংলার অনেক রোকসানার মতো তিনিও অক্লান্ত পরিশ্রম করে সংসার চালানোর পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী কৃষি সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখছেন। তাঁর শিম চাষের উদ্ভাবনী পদ্ধতি ও গবেষণা স্থানীয় কৃষকদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে।