দা জোরো (জল ঝরা) খরা মোকাবেলায় একটি আদি পদ্ধতি
বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে শহিদুল ইসলাম
ভূমিকা
বাংলাদেশের সন্নিহিত জনপদগুলোর মধ্যে সব থেকে প্রাচীন ও সমৃদ্ধময় জনপদ ছিলো বরেন্দ্র অঞ্চল। বর্তমান বাংলাদেশের উত্তর-পশ্বিোঞ্চলে অবস্থিত রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের জেলাগুলো নিয়ে এই বরেন্দ্র অঞ্চল। তবে খরাপ্রবণ বা বরেন্দ্র অঞ্চল বলতে বেশিরভাগ মানুষ রাজশাহী, চাঁপাইনবাগঞ্জ, নওগাঁ ও দিনাজপুর জেলাকে বেশি বুঝে থাকে। কারণ রাজশাহী, নওগাঁ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মতো খরা, অনাবৃষ্টি বাংলাদেশের অন্যান্য জেলাগুলোতে দেখা যায় না। প্রাচীন যুগে এই অঞ্চলটি সমৃদ্ধময় থাকলেও দিনে দিনে এই অঞ্চলে নানা সংকট তৈরি হয়েছে যেমন তেমনি অনেক সম্ভাবনাও নতুন করে তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে এই অঞ্চলের প্রধান নদী পদ্মা বা গঙ্গা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করা এবং একইসাথে অতিরিক্ত ভুগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে এখানে দিনে দিনে পানি সংকট দেখা দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের আঞ্চলিক অভিঘাতের কারণে এখানে অনাবৃষ্টি এবং খরা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এই খরা এবং অনাবৃষ্টিকে মোকাবেলা করেও কৃষক তাঁর খাদ্য উৎপাদন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। খরা সংকটের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ এবং সংকট উপযোগী জ্ঞান-বুদ্ধি প্রয়োগ করে কৃষক শাকসবজি ও শস্য ফসল উৎপাদন করছেন। তেমনি একটি ফ্রান্সিস পাউরিয়া এবং ফুলমনির পরিবার ।
পানির আকাল, খরার সাথে বসবাস করে চলছে জীবন সংগ্রাম
চারিদিকে পানির আকাল। কোথাও পানি নেই। খাবার পানি সংগ্রহ করতে যে গ্রামের মানুষকে অনেক কষ্ট করতে হয়, সেখানে চাষাবাদের পানিতো আরো দুষ্কর। বলছি খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার আদিবাসি মাহালি পাড়ার কথা। রাজশাহী জেলার অর্ন্তগত তানোর উপজেলার আওতাধীন মুন্ডুমালা পাঁচন্দ মাহালি পাড়ার পৌরসভার ১নং ওয়াডের পাচন্দর মাহালী পাড়া গ্রাম। গ্রামটি তানোর আমনুরা পাকা রাস্তার সংলগ্ন দক্ষিণ পাশে অবস্থিত। গ্রামে ৫০টি আদিবাসী পরিবার বসবাস করে। লোকসংখ্যা ছোট বড় মিলে ২৫০ জন। সবাই ভূমিহীন, দিনমজুর। তাদের প্রধান পেশা বাঁশ বেতের কাজ। বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের জিনিস যেমন সাজি, কুলা, সরপস, টিপা তৈরি এবং তা বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। মাহালি পাড়া গ্রামটিতে পানির সমস্যা প্রকট। অতীতে গ্রামটিতে একটি কুয়া ছিল। এই কুয়া থেকে গ্রামের সবাই খাবার পানি তুলতো। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এই একটি মাত্র কুয়ো দিয়ে তাদের পানি চাহিদা মিটতো না। অনেকবছর ধরেই এই কুয়ার পানিই তারা ব্যবহার করে আসছেন। আবার খরা এবং ভূগর্ভস্থ পানি নীচে নেমে যাবার কারণে কুয়ার পানি উঠা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে পানি সঙ্কট আরও প্রকট আকার ধারণ করে। গ্রামের মানুষ খাবার পানির সংকট মেটাতে দূর দূরান্তে থেকে পানি সংগ্রহ করত। আর এই পানি নারীরাই সংগ্রহ করে থাকেন। দূর থেকে পানি বয়ে আনার কারণে নারীদের নানা রোগবালাই এবং শারীরিক অসুস্থতা বেশি দেখা যায়।
একসময় গ্রামের পাশের পুকুর গুলো থেকে পানি সংগ্রহ করে পরিবারের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটালেও কালের বিবর্তনে পুকুরগুলো শুকিয়ে গেছে এবং যা আছে, সেগুলো লিজ দেবার কারণে সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করতে দেয়া হয় না। সবমিলে দিনে দিনে এই পাড়াতে পানির সংকট বাড়ছেই। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও নানা কৌশল এবং পদ্ধতি ব্যবহার করে গ্রামের পরিবারগুলোর জীবন সংগ্রাম চলে।
খরা ও পানি সংকট মোকাবেলায় “দা জোরো” পদ্ধতি ব্যবহার করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন আদিবাসি পাউরিয়া পরিবার
মাহালি পাড়াটিতে পানি জন্য হাহাকার লেগেই আছে। খাবার পানিই যেখানে পাওয়া যায়না সেখানে শাকসবজি চাষ করার জন্য পানি পাওয়াতো আরো দুষ্কর। এর উপরি আবার অনাবৃষ্টি এবং খরা লেগেই আছে। এতো কিছুর মধ্যেও জীবন তো চলতে হবে। দীর্ঘদিন খরার সাথে বসবাস করার ফলে পাউরিয়া এবং ফুলমনি পরিবার আবিষ্কার করেন “দা জোরো” ( পানি ঝরা) পদ্ধতি । নিজস্ব জ্ঞান এবং বুদ্ধি দিয়ে তিনি সবজি বা ফলমুলের গোড়ায় “দা জোরো” পদ্ধতি ব্যবহার করে পানির সমস্যা সমাধান করেন। জীবন্ত রাখেন সবজি গাছসহ ফলমূলের গাছকে। এ ছাড়াও ফুল মনি ও পাউরিয়া জমিতে লোকায়ত মালচিং ব্যবহার করেন। মালচিং এ তিনি খড়-লতা পাতা ব্যবহার করেন। এভাবে এই পানি সংকটের মধ্যেও খরা মোকাবেলা করে, লোকায়ত কৌশল ব্যবহার করে পরিত্যাক্ত জমি ব্যবহার করে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করছেন গ্রামের ফ্রান্সিস পাউরিয়া ও তার স্ত্রী ফুলমনি। তাঁদের যৌথ ও সফল প্রচেষ্টা অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে গ্রামটিতে। যা এই পাড়ার অন্যান পরিবারের অনুসরণীয় হয়েছে।
ফুলমনি ও পাউরিয়া পরিবার বাড়ির পাশে পালানি ১০ শতক জমিতে নানা ধরনের শাকসবজি এবং ফলমুল উদপাদন করছেন। তাঁদের নিজের উৎপাদিত শাকসবজি ও ফলমুল নিজে ব্যবহার করার পর যা বেশি থাকে তা নিজের পাড়ার মানুষের মধ্যে বিলি করে দেন।
গ্রামটিতে ৫০টি পরিবারের মধ্যে এখন পাইরিয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রায় ২৫টি পরিবার শাকসবজি উৎপাদন করছেন। “দা জোরো” পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। এখানে উল্লেখ যে “দা জোরো” পদ্ধতি হলো একটি বোতলে করে এক বোতল পানি নিয়ে নীচে ছিদ্র করে সুতার লাগিয়ে দিয়ে তা গাছের গোড়ায় বেধে বা টাংগিয়ে দেয়া হয়। এই এক বোতল পানি সুতার মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে চুয়ে চুয়ে ফোটায় ফোটায় অনেক ধীরে পড়ে গাছে গোড়ায়। আবার গাছের গোড়ায় খড়-কুটা, লতাপাতা দিয়ে মালচিং ব্যবহার করা হয়। এভাবে দীর্ঘ সময় গাছের গোড়ায় রস /পানি জমা থাকে। গাছ তার প্রয়োজনীয় রস পেয়ে জীবন্ত থাকে। এতে করে পানি লাগে একেবারেই কম। বাড়িতে শাকধোয়া , চাল ধোয়া এবং গোসলের পানি ফেলে না দিয়ে তা সবজি বাগানে ব্যবহার করেন। সবজি চাষে পরিবারগুলো গোবর সার ব্যবহার করেন এবং কীটনাশকের পরিবর্তে ছাই এবং জৈব বালাই ব্যবহার করেন।
খরার সময় পাউরিয়া পরিবারের পানি সংরক্ষণ পদ্ধতি
চারিদিকে রোদ আর রোদ। রোদ আর গরম। ফুলমনি বলেন, ‘থালায় যদি একটু পানি রেখে রোদে রাখা যায় তাহলে মুহুর্তে তা শুকিয়ে যায় রোদের তাপে। তীব্র তাপদহ বরিন্দে দিনে দিনে বেড়েই চলেছে“ । এমন খরার সময় বিশেষ করে চৈত্র্য-বৈশাখ মাসে পানির আকাল বেশি দেখা দেয় অন্যান্য মাসের তুলনায়। কারণ চারিদিকে শুকিয়ে যায়। কোথাও পানি পাওয়া যায়না। এমন সময়ের জন্য পাউরিয়া পরিবার একটি ছোট পুকুর করে পানি সংরক্ষণ করেন। পুকুরে যাতে সূর্যের রোদ পড়ে পানি শুকিয়ে বা উড়ে যেতে না পারে, সে জন্য তিনি পুকুরের উপরে চারিধারে কলার গাছসহ বিভিন্ন ফলফলাদি ও বনজগাছসহ ঝোপঝাড়ের গাছ লাগিয়েছেন। এর ফলে পুকুরে পানি সবসময় ঠান্ডা থাকে। রোদ পড়তে না পারায় সেখানের পানি সহজে বাষ্পিভুত হতে পারেনা। এই পুকুরে পাউরিয়া পরিবার মাছের চাষ করে নিজের পরিবারের চাহিদা মেটান। বিশেষ করে দেশি মাছগুলো এখানে চাষ করেন। খরার সময় এই পুকুর থেকে পানি নিয়ে সবজি ও ফলমূলের গাছে ব্যবহার করা হয়। গ্রামের অন্যান্য পরিবারগুলোও এখন থেকে পানি নিয়ে ব্যবহার করেন।
ফুলমনি-পাউরিয়ার পরিবার খরা মোকাবেলা করে বাড়ির পরিত্যাক্ত জায়গায় শাকসবজি- ফলমূলের চাষ তাঁর নিজের পরিবারের পুষ্টিকর নিরাপদ খাদ্যের যেমন যোগান দিচ্ছেন তেমনি তাঁদের এই অভিজ্ঞতা অন্যান্যদের মধ্যে বিনিময় হবার ফলে অন্যান্য পরিবারগুলোও তাঁদের নিরাপদ খাদ্যের সংস্থান বা উৎপাদন নিজেরাই করতে পাচ্ছে। কোন ধরনের রাসায়নিক এবং কীটনাশকের ব্যবহার না করায় এই সবজি যেমন শরীর, স্বাস্থ্যর জন্য অনেক উপকার করছে, তেমনি পরিবেশ প্রাণবৈচিত্যের উপকার করছে। একইসসাথে তারা দেশিয় প্রজাতির শাকসবজির বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণও করছেন।
করোনাকালে ফুলমনি-পাউরিয়ার পরিবারসহ অন্যান্য পরিবারগুলো এভাবে সবজি উৎপাদন করে নিজের গ্রামের অন্যান্যদের মধ্যেও বিতরণ করেছেন, যা করোনাকালে খাদ্য সংকট মোকাবেলায় বিশেষ অবদান রেখেছে।