বৈচিত্র্যময় ফসল চাষে ভূমিকা রাখছে চরের ‘বীজবাড়ি’
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে মুকতার হোসেন
হরিরামপুর উপজেলার লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নে পাটগ্রামচরে লেছড়াগঞ্জ চর উন্নয়ন কৃষক সংগঠনের সদস্যরা ‘বৈচিত্র্যময় ফসলের বীজ সংরক্ষণ কেন্দ্র’ গড়ে তুলেছেন। কৃষকরা যাতে তাদের স্থানীয় জাতের বীজ, বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ করতে পারেন সেজন্য সংগঠনের সভাপতি হাজেরার বাড়িতে এই বীজবাড়ি গড়ে তুলেছেন ২০১৪ সালে।
মেঝে পাকা একটি টিনসেট ঘর সংগঠনের সভাপতি হাজেরা বীজ কেন্দ্র হিসেবে সংগঠনের সদস্যদের জন্য প্রদান করেন। সংগঠনের মাসিক সমন্বয় সভার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, সদস্যদের মধ্যে যার যার বাড়িতে স্থানীয় জাতের রয়েছে তারা সেই বীজগুলোর কিছু অংশ এই বীজবাড়িতে জমা দিতে বলা হয়। এছাড়া আশেপাশের গ্রামের অন্যান্য কৃষক-কৃষাণীদের নিকট থেকে বিভিন্ন ধরনের সবজি, ধান, তেল জাতীয়, মসলা ও ডাল জাতীয় ফসল সংগ্রহ করেন সংগঠনের সদস্যরা। অন্যদিকে এই বীজবাড়িকে সমৃদ্ধ করার জন্য বরুন্ডি বীজব্যাংক থেকে কিছু সংগ্রহ করা হয়।
সংগঠনের সদস্যরা সে বীজগুলো নিজেরা বিনিময়ের মাধ্যমে এলাকায় চাষাবাদ শুরু করেন। তাঁরা যার বাড়িতে যে বীজ আছে, যার বীজ নেই সেই বীজ দিয়ে তাঁকে সহায়তা করতো এই বীজবাড়ির মাধ্যমে। এভাবে সমন্বয়ের মাধ্যমে বীজকেন্দ্র থেকে বীজ লেনদেন করা হয়। প্রথমে মাত্র ১০ ধরনের বীজ নিয়ে বীজবাড়ি শুরু হলেও বর্তমানে বীজ বাড়িটিতে ১২০ ধরনের বীজ রয়েছে। বর্তমানে বীজবাড়িতে যে ধরনের বীজ রয়েছে তা হলো: গম, পায়রা, মুসুরী, মাস কালাই, মুগডাল, শরিষা (মাঘি, চৈতা, বারী ১৪), তিল, তিসি, আলমডাঙ্গা জাতের মরিচ, নলডঙ্গা শিম, চ্যাপটা শিম, মৌ শিম, মূলা, লালশাক, বেগুন, সজ, রাধুনী, কালোজিরা, লাউ, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, মোটরকালাই, খেসারি কালাই, দিঘা ধান, আউশ (পরাঙ্গি), ডেপুশাল, বাশ ডাটা, করল্লা বীজ, কাউন, বরবটি, আদা, রসুন, গাছ আলু, মাছ আলু।
বীজবাড়ির কার্যক্রমে প্রথমে যারা বীজ বিনিময় করতেন তাদের কোন তালিকা রাখা হত না। পরবর্তীতে রেজিস্টার খাতার মাধ্যমে বীজ বিনিময়কারী তালিকা করা হয়। রেজিস্টার খাতা এবং সংগঠনের সভাপতি হাজেরা তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ৬২০ জন কৃষাণী বীজবাড়ি থেকে বীজ বিনিময় করেছেন। ইতিমধ্যে দাতা সংস্থার প্রতিনিধি ডিয়াকোনিয়া এবং সিডার প্রতিনিধি চরের বীজ সংরক্ষণ কেন্দ্রটি পরিদর্শন করেন। এছাড়া আশেপাশের গ্রাম এবং অন্যান্য গ্রামের মানুষ অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরে আসেন এই বীজবাড়ি পরিদর্শনের জন্য।
বারসিক এলাকার বীজের সংকট দূরীকরণ, বাজার নির্ভরশীলতা কমানো এবং স্থানীয় জাতের বীজ বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করার জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে। তাঁদের নিজস্ব চর্চা বা উদ্যোগগুলোকে গতিশীল করতে সহায়তা করে। অন্যদিকে বীজ সংরক্ষণের লোকায়ত চর্চা এবং স্থানীয় মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজের লাগিয়ে দুর্যোগ মোকাবেলায় বারসিক চরাঞ্চলের মানুষকে নানানভাবে উৎসাহিত করে। সংগঠনটি চরাঞ্চলের মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ আয়োজন করে। এছাড়া প্রয়োজন হলে সামান্য উপকরণ সহযোগিতাও করে। এভাবে ‘বীজবাড়ি’ গড়ে তোলার জন্য বারসিক বীজ সংরক্ষণের জন্য ৫টি ড্রাম, মাটির পাত্র, কৌটা, রেজিস্টার খাতা দিয়ে সহযোগিতা করে। এছাড়াও অভিজ্ঞা বিনিময়ের সফরের আয়োজন, বীজ মেলার আয়োজন, বিলবোর্ড প্রদান, অভিজ্ঞ কৃষক দিয়ে গ্রাম পর্যায়ে আলোচনা সভার মাধ্যমে এ সংগঠন চরাঞ্চলের মানুষকে সহায়তা করে যাচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে হালুয়াঘাটা গ্রামে কৃষক সোনামুদ্দিন (৫৮) বলেন, ‘চরের বীজ সংরক্ষণ কেন্দ্র তৈরির মাধ্যমে এলাকায় ফসল বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষকরা বীজ বিনিময় করছেন এবং তথ্য আদান প্রদানের মাধ্যমে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এলাকার কৃষক-কৃষাণীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের বীজ সংরক্ষণ দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বীজের জন্য বাজার নির্ভরশীলতা কমে গেছে। এলাকার কৃষক-কৃষাণী প্রয়োজন অনুযারী মৌসুমভিত্তিক চাষাবাদ করতে পারছেন। নিজ বসতভিটায় শাকসবজি চাষ করে নিজের খাবারের চাহিদা পূরণ করতে পারছেন। এছাড়া বাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবেও লাভবান হয়েছেন।’ অন্যদিকে ‘বীজবাড়ি’কে কেন্দ্র করে আশেপাশের মানুষের সাথে সংগঠনের সদস্যদের নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন গ্রাম থেকে কৃষক ও নারীরা এই বীজবাড়ি পরিদর্শন করেন এবং প্রয়োজনীয় বীজ সংগ্রহ করছেন। এ বিষয়ে সংগঠনের সভাপতি হাজেরা বেগম বলেন, ‘অনেক জাতের বীজ আমাদের এলাকায় ছিল না। কিন্তু বীববাড়ির করার পর নলডগা শিম, পায়রা, বাশডাটা, কাউন, তিসির মতো বীজও আমরা সংগ্রহ করতে পেরেছি।এখান থেকে মানুষ বীজ নিয়ে চাষ করছেন। তাঁরা আবার আরেকজনকে দিচ্ছেন। এভাবে বীজবাড়ি বিভিন্নভাবে ভূমিকা রাখছে।’ পাটগ্রামচরের কৃষাণী লাইলী বেগম বলেন, ‘আমি বীজবাড়ি’ থেকে লাউ বীজ নিয়ে লাগিয়ে চলতি মৌসুমে ৭০০০ টাকা লাউ বিক্রি করেছি। যে টাকা আমার সংসারে অন্যান্য খাতে খরচ করতে পারছি।’
উল্লেখ্য, চর এলাকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়। এমনকি স্থানীয় জাতের অনেক ফসলের বীজের এলাকার মানুষের কাছে থাকে না। বীজ সঙ্কটে পড়তে হয়। এজন্য গ্রামের অনেক মানুষ বাজারমূখী হচ্ছেন এবং বিভিন্ন কোম্পানির বীজ হাট ও বাজার থেকে কেনেন। ফলে একদিকে যেমন তাদের স্থানীয় জাতের বীজ বৈচিত্র্য হারিয়ে যেতে শুরু করেছে অন্যদিকে আর্থিক খরচের পাশাপাশি বীজকেন্দ্রিক তাদের যে নিজস্ব দক্ষতা, চর্চা ও অভিজ্ঞতা ছিলো সেগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে।