সাম্প্রতিক পোস্ট

প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণকে বাঁচাই, আমরাও বাঁচি

সিলভানুস লামিন

এক
এই বিশ্বে ব্রহ্মাণ্ডে মানুষ ছাড়াও আরও কোটি কোটি প্রাণ আছে। মানুষের মতো তারা প্রত্যেকেই এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সদস্য। সুতরাং এই ব্রহ্মাণ্ডের ভালোমন্দ তাদেরকেও নাড়া দেয়, এর সুযোগ-সুবিধা তারাও গ্রহণ করতে চায় এবং ভালোমত বেঁচে থাকার অধিকার তাদেররও আছে। আমরা অনেকসময় ভুলে যাই যে, আমরা এসব কোটি কোটি প্রাণের ওপর নির্ভরশীল। তাদের অস্তিত্ব ছাড়া আমাদের অস্তিত্বও যে থাকতে পারে না তা আমরা খুব গভীরভাবে চিন্তা করি না। আমাদের পরিবার যদি একটি ইউনিট হয় তাহলে মা, বাবা, ভাইবোন, সন্তানসন্ততিসহ সবাই এই পরিবারের সদস্য। আমরা যদি একটু বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাবো যে, এই বিশ্বে ব্রহ্মাণ্ডও আমাদের একটি পরিবার। আমরা মানুষহ কোটি কোটি প্রাণ এই পরিবারের এক একটি সদস্য। আমাদের পরিবারের সদস্যদের ভালো থাকা, সুস্থ থাকা এবং উন্নতি করার কামনা করি সবসময়ই। পরিবারের কোন সদস্য অসুস্থ হলে আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি, কেউ বিয়োগ হলে আমরা মর্মাহত ও শোকাহত হই। কিন্তু পরিবারসমেত এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে র সদস্য কোন তথা গাছ নষ্ট হলে, কোন বন বিলুপ্ত হলে, কোন নদী মারা গেলে, কোন পাখি, এমনকি সুক্ষ্ম কোন প্রাণ হারিয়ে গেলে আমরা কোনদিনও মর্মাহত হই না। বরং এসব প্রাণকে হত্যা, ধ্বংস ও নষ্ট করার প্রধান আসামী আমরা নিজেরাই। তাই আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় এই বিশ্বের সবচে’ হিংস্র প্রাণীর নাম কি? আমি নির্দিধায় বলবো ‘মানুষ’! মানুষের মতো হিংস্র প্রাণী এই বিশ্বে আরেকটিও নেই।

দুই
বর্তমান বিশ্বে খুব দ্রুত হারেই বিভিন্ন প্রাণ বিলুপ্ত হচ্ছে। বিলুপ্তির দায়ভার আমাদের মানুষের ওপর পড়ে। কারণ প্রকৃতির অন্য সদস্য আমাদের কোনক্ষতি না করলেও আমরা কিন্তু অহরহ তাদের ক্ষতি করি। আমাদের স্বার্থের জন্য আমরা বন, নদী, খালবিল ধ্বংস করি (আবাসস্থল, অবকাঠামোসহ আরও অনেককিছু তৈরির জন্য), আসবাবপত্রের জন্য বৃক্ষ নিধন করি, খাদ্যের জন্য প্রাণী হত্যা করি, সমুদ্রের কোটি কোটি প্রাণসত্তাকে আমরা বিপন্ন করি! আবার আমাদের মানুষের সুখ ও স্বাচ্ছন্দের জন্য পাহাড় কাটি, খনিজ পদার্থ (পাথর, কয়লা, চুনাপাথর, বালু) মাটিকে তছনছ করে খনন করি! আমরা যখন এসব কাজ পরিচালনা করি তখন এসব বাস্তুসংস্থানে কোটি কোটি প্রাণের অস্তিত্বকে বিপন্ন করি! অনেকসময় এসব প্রাণসত্তা আমাদের এসব উন্নয়নমূলক (?) কাজের মধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়েছে। আমরা শুধু হত্যা বা ধ্বংস করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকিনি; বরং মানবজাতির জন্য কিংবা নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য নিত্যনতুন প্রযুক্তি (জিএম, হাইব্রিড, মনোকালচার, গ্রীনহাউস, জিওইঞ্জিনিয়ারসহ আরও অনেক প্রকৃতিবিনাশী প্রযুক্তি। অবশ্য সব প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়) আবিষ্কার করে প্রকৃতির প্রাকৃতিক নিয়মকে ব্যাঘাত করি, প্রকৃতিকে সহিংসতায় বিদীর্ণ করি এবং প্রকৃতিকে শোকাহত করি। এসব প্রযুক্তি প্রয়োগের প্রকৃতির অতিসুক্ষ্ম থেকে বড় আকারের প্রাণসত্তারও ক্ষতি হয়, বিপন্ন হয়। তাই তো এই বিশ্বে মানুষের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়লেও অন্য প্রাণসমূহের সংখ্যা প্রতিদিনই হ্রাস পাচ্ছে। কোন কোন প্রাণ ও প্রজাতি তো বিলুপ্তই হয়েছে, কিছু কিছু প্রাণ ও প্রজাতি আজ বিপন্ন, বিলুপ্তির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে তারা। হিংস্র মানুষের পদচারণায় আজ এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিদিন। এই পরিবর্তন কিন্তু নেতিবাচক!

তিন
বিভিন্ন প্রাণের সমাহারকে আমরা প্রাণবৈচিত্র্য বলতে পারি। এসব প্রাণের জন্যই যে আমরা এখনও বেঁচে আছি সেটা আমরা কী অস্বীকার করতে পারি? পারিনা! প্রতিটি প্রাণসত্তার ওপর আমরা প্রত্যক্ষা ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। আমরা মানুষ নিজেও এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের এক একটি উপাদান। প্রতিটি উপাদানের সাথেই একটি আন্তঃনির্ভরশীলতা বিদ্যমান। এই সম্পর্কটি কখনও খুবই সুক্ষ্ম আবার কখনও খুবই স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় আমাদের জীবনে। যেমন: খাদ্য, পোশাক, পুষ্টির জন্য আমরা বনসম্পদের ওপর নির্ভর করি। অক্সিজেনের জন্য আমরা গাছপালার ওপর নির্ভর করি। আবার সুক্ষ্ম সম্পর্কটি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, প্রাণবৈচিত্র্য সুপেয় পানির আধারকে সুরক্ষা করে, পরিবেশ-প্রতিবেশকে স্বাস্থ্যবান রাখে, মাটির গঠনে সহায়তা করে এবং মাটিকে উর্বর করে, দূষণ হ্রাসে ভূমিকা রাখে, সম্পদ নবায়নের কাজ করে, জলবায়ুকে স্থিতিশীল রাখে ইত্যাদি। এর সাথে আমাদের মানুষের একটি সম্পর্ক রয়েছে। কারণ আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সুপেয় পানি থেকে শুরু করে, সজেত পরিবেশ-প্রতিবেশ, স্থিতিশীল জলবায়ু খুবই প্রয়োজন। এ সম্পর্ক যদি আমরা উপলদ্ধি করতাম তাহলে একটি প্রাণ হত্যা করার আগে, বনভূমি উজাড় করার আগে, নদীনালা, জলাভূমি দখল ও ভরাট করার আগে আমরা অনেকবার ভাবতাম! কিন্তু আমরা কখনও সেটি ভাবিনা বলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রাকৃতিক উপাদানকে ধ্বংস করি প্রতিনিয়ত, প্রাকৃতিক উপাদানগুলোকে অহরহ হত্যা করতে বিন্দুটুকু অনুশোচনা হয় না আমাদের।

চার
আমাদের দেহের প্রতিটি অঙ্গই আমাদের কাজে লাগে। প্রতিটি অঙ্গেরই আলাদা আলাদা একটি ভূমিকা রয়েছে। ছোটকালে একটি গল্পে পড়েছি যেখানে আমাদের দেহের প্রতিটি অঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়। ওই গল্পে দেহের সব অঙ্গেই পেটের ওপর ভীষণ ক্ষেপা! কারণ পেট শুধু বসে খায়। গল্পে, পা বললো, ‘আমি তো হাটি। দূর দূরান্ত পর্যন্ত নিয়ে যাই সবাইকে।’ হাত বললো, ‘আমি কাজ করি, খাবার তুলি মুখে।’ মাথা বললো, ‘আমি চিন্তা করি, আমি দেহের ভারসাম্যকে রক্ষা করি।’ মুখ বললো, ‘আমি খাবার খাই, চিবোই দেহকে শক্তি দিই।’ প্রতিটি অঙ্গ পেটকে সবচে’ বড় ‘অলস’ হিসেবে অভিহিত করে। তাই সবাই মিলে পেটকে ‘শাস্তি’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তারা পেটকে খাবার দিবে না, কোথাও যাবে না, কাজ করবে না। এভাবে তারা একদিন, দু’দিন পেটকে খাবার দেয়নি। তিনদিনের মাথায় গিয়ে তারা অনুভব করলো, পেটকে শাস্তি দিতে গিয়ে তারাই দুর্বল হয়ে পড়লো। হাত নিস্তেজ হলো, পা নিজেও নড়াচড়া করতে পারলো না। হাত, পা, মাথা, কান, চোখ সবাই দুর্বল হতে লাগলো। অবশেষে তারা উপলদ্ধি করলো যে, ‘পেট’-এর কাজ আছে যা, তারা কখনও স্বচোখে দেখেনি। তারা উপলদ্ধি করলো, দেহের প্রতিটি অঙ্গেরই আলাদা আলাদা ভূমিকা ও কাজ রয়েছে। এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে আমরা যদি একটি ‘দেহ’ মনে করি এবং এর প্রতিটি উপাদানই এক একটি অঙ্গ ভাবি তাহলে দেখতে পাবো যে, এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি প্রাণ, প্রতিটি সদস্যই আলাদা আলাদা গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। দেহস্বরূপ এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে ভালো করে রাখার জন্য তাদের প্রত্যেকের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই কোন সদস্য তথা প্রাণসত্তাকে হত্যা করলে কিংবা ধ্বংস করলে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ভালো রাখার ‘প্রক্রিয়া’ ব্যাহত হয়, এর ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং ফলশ্রুতিতে এর ক্ষতি হয় (আমরা কমবেশি সেটা জানি)। একটি প্রাণ মরে গেলে, ধ্বংস হলে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড মানুষের দেহের মতো দুর্বল হয়ে পড়ে, তার ‘ছন্দময়’ জীবনে ব্যাঘাত ঘটে।

পাঁচ
বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অন্যতম বুদ্ধিদীপ্ত সদস্য হিসেবে প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানকে সুরক্ষা, পরিচর্যা ও সংরক্ষণ করার দায়িত্ব মানুষের ওপর বর্তায়। প্রকৃতিকে তছনছ করা, প্রকৃতির স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করা এবং প্রকৃতির অন্যান্য সদস্যকে অবহেলা, শোষণ, শাসন এবং অত্যাচার যাই বলি না কেন, আমরা মানুষেরাই বেশি করেছি। আমাদের নিজের কল্যাণ ও উন্নয়নের জন্য এসব করে আসছি এবং এখনও অনবরতভাবে করে যাচ্ছি। নিজের কল্যাণ ও উন্নয়ন করতে গিয়ে আমরা আমাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ভালো থাকা, তাদের মঙ্গল, অস্তিত্ব এবং বৃদ্ধিকে বেমালুম ভুলে গেছি আমরা! তাই প্রকৃতির অন্যান্য উপাদানের বিলুপ্তি, ধ্বংস এবং হারিয়ে যাওয়ার প্রবণতাকে বন্ধ করতে হবে। প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণসত্তার বিলুপ্তি হ্রাসকরণে যেসব বৈশ্বিক উদ্যোগ রয়েছে সেগুলোকে বেগবান করতে হবে। বৈশ্বিক উদ্যোগ ছাড়াও ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে যেসব উদ্যোগ রয়েছে সেগুলোকে দৃশ্যমান করতে হবে যাতে অন্যরা উৎসাহিত হয়। মানুষের জীবনে প্রকৃতির বিভিন্ন প্রাণসত্তার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা এবং তাৎপর্য সম্পর্কে মানুষকে অবগত ও সচেতন করতে হবে এবং এসব প্রাকৃতিক উপাদানের বিলুপ্তি, হ্রাস ও ধ্বংস মানুষের জন্য ঝুঁকি ও বিপদ নিয়ে আসবে সে বিষয়টিও স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে। যাতে প্রকৃতি থেকে আমরা মানুষেরা স্থায়িত্বশীল উপায়ে সম্পদ আহরণ করি। অন্যদিকে প্রকৃতির বিভিন্ন প্রাণসত্তার সংরক্ষণ, স্থায়িত্বশীল ব্যবহার এবং এসব উপাদান থেকে নিঃসৃত সেবার সমান অংশীদারিত্বের জন্য প্রয়োজন বিদ্যমান নীতিমালা ও বিভিন্ন প্রশাসনিক যন্ত্রের মধ্যকার সমন্বয়। বিশ্বের মানুষ প্রাণবৈচিত্র্য সনদ প্রণয়ন করেছে। এই সনদের সঠিক বাস্তবায়নে দরকার সঠিক রাষ্ট্র নেতৃত্ব এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সহযোগিতা। এই সনদের উদ্দেশ্য এবং সামগ্রিক লক্ষ্য হচ্ছে মানব উন্নয়ন। আর মানব উন্নয়ন তখন সাধিত হবে যখন প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণসত্তা বেঁচে থাকবে। তাই আসুন বিভিন্ন প্রাণসত্তার বিলুপ্তি হ্রাস করার জন্য আমরা ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিই এবং সামাজিক ও বৈশ্বিক উদ্যোগগুলোকে গতিশীল করতে সহায়তা করি।

happy wheels 2

Comments