মানুষের সেবা করেই যাচ্ছেন দেলোয়ারা বেগম
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
সেবাই ধর্ম। যুগে যুগে সৃষ্টির সেবায় আত্মনিয়োগ করে কালের ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন অনেক মানুষ। মরেও অমর হয়ে আছেন নিজেদের কাজের গুণে। সেই আলোকে অনুপ্রাণিত হয়ে জীবন পরিচালনাায় উৎসাহিত হয়েছেন অনেকে। নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে সেবাকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছেন, যুক্ত হয়েছেন সমাজ উন্নয়নের কাজে। রুঁখে দাঁড়িয়েছেন পরিচালিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। পরিবর্তনশীল সময়ের ব্যবধানে সমাজ উন্নয়নের সেই ধারায় আজ নেতৃত্বদানে অবদান রাখচেন গ্রামীণ প্রান্তিক নারীরাও। তেমনই একজন নারী বাদঘাটা আইসিএম কৃষি ক্লাবের সভানেত্রী দেলোয়ারা বেগম (৪৫)।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বাদঘাটা গ্রামে দেলোয়ারার বাড়ি। স্বামী, সন্তান, নাতি-নাতনী নিয়ে দেলোয়ারার সুখী একটি পরিবার। বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত পারিবারিক জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তিনি মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। ছোটবেলা থেকে তিনি ছিলেন অনেক সাহসী এবং তার দাদীর অনেক কাছের। সাহসী এবং দাদীর কাছের হওয়ায় দাদী তার নিজ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে বাঁচিয়ে রেখে মানুষের সেবা করার মানসিকতায় আদরের নাতনী দেলোয়ারাকে শেখান। দাদী গ্রামের মানুষকে ধাত্রী সেবা দিতেন। উত্তরসূরী হিসেবে দেলোয়ারাকেও শেখান ধাত্রী সেবার কাজ। দাদীর সাথে থেকে একাজ করতে আনন্দ পেতেন তিনি।
দেলোয়ারা বেগম জানান, প্রায় ২৬ বছর ধরে তিনি এ কাজটির সাথে জড়িত। এ কাজের অভিজ্ঞতা থেকে একটা সময় এসে শ্যামনগর সদর হাসপাতালে নার্সদের সহকারি হিসেবে চাকরি পান। তখন দেলোয়ারা বিবাহিত ও এক কন্যা সন্তানের জননী। চাকরি করতে গেলে পাছে স্বামী সন্তানের যত্নের ত্রুটি হবে এবং পেশাগত কারণে সমাজ উন্নয়নের লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে যেতে পারে ভেবে পরিবার থেকে চাকরি করতে বাধা পান। সংসার সামলানোর পাশাপাশি তাই ধাত্রী সেবার মাধ্যমে মানুষের পাশে থাকতে চেষ্টা করেছেন প্রতিনিয়ত। এ কাজের মাধ্যমে তিনি গ্রামের মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সম্মান কুড়িয়েছেন অনেক। আর এ প্রাপ্তি তার ভাবনাকে আরো গভীর করে তোলে। তিনি সমাজ এবং সমাজের মানুষের জন্য ভালো কিছু করার কথা ভাবেন সবসময়। আর এ ভাবনা থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক যখন অবহেলিত, নির্যাতিত, অসহায়, দুঃস্থ মানুষদের নিয়ে গ্রামে কাজ করতে আসেন তখন সেই সুযোগকে কাজে লাগান তিনি।
ব্র্যাক গ্রামে এ ধরনের নারীদের নিয়ে পল্লী সমাজ গঠন করে। ব্র্যাকের পল্লীসমাজের সাথে যোগ দেন। নেতৃত্ব দিতে থাকেন পল্লীসমাজ গ্রুপের। পল্লী সমাজ গ্রামীণ নারীদের অধিকার, স্বাস্থ্য, পুষ্টি সেবা নিয়ে সচেতনতার জন্য উঠান বৈঠক করতো। দেলোয়ারা বেগম ব্র্যাকের সহায়তায় গ্রামীণ নারীদের জন্য কাজ করতে শুরু করেন। আর এ কাজের মাধ্যমে তিনি ব্র্যাকের সেচ্ছাসেবক নিযুক্ত হন। স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও অধিকার বিষয়ে ব্র্যাক থেকে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ পেতে থাকেন। এসব প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ তাকে আরো বেশি অভিজ্ঞ করে তোলে, তার কাজকে আরো গতিশীল করতে সহযোগিতা করে। নিজ গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, গর্ভবতী মায়েদের ধাত্রী সেবা, যক্ষ্মা রোগীদের চিকিৎসা, শিশু পুষ্টি প্রভৃতি বিষয়ে কাজ করে তিনি একজন সমাজসেবা কর্মী হিসাবে পরিচিত।
ধাত্রী সেবা কাজের সাথে ২৬ বছরের যুক্ততায় জুন ২০১৭ পর্যন্ত তিনি প্রায় ২৬০০ পরিবারে ধাত্রী সেবা প্রদান করেছেন দেলোয়ারা বেগম। স্বাস্থ্য পরামর্শ দিয়েছেন গর্ভবতী মায়েদের। কোন মাসে ৪/৫টি পারিবার, কোন মাসে ৮/১০টি পরিবার আবার কোন মাসে ১৫/১৬ টি পরিবারে ধাত্রী সেবা দিয়ে থাকেন। ধাত্রী সেবার পাশাপাশি তিনি ৭ বছর ধরে যক্ষ্মা রোগীদের সেবা দান করছেন। এ পর্যন্তÍ তিনি ৫৫ জন যক্ষ্মা রোগীর সেবা ও পরামর্শ দিয়েছেন। এর পাশাপাশি সেচ্ছাশ্রমে গর্ভবতী মায়েদের খাদ্য, পুষ্টি সেবা তো আছেই। কাজগুলো সম্পাদনে তার অনুভূতি জানতে তিনি বলেন, “আমি এ কাজ করতে আনন্দ পাই। এ কাজের মধ্য দিয়ে গ্রামে ও সমাজে অনেক পরিচিতির পাশাপাশি অনেক মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভরসা অর্জন করেছি। রোগীর বাড়ির মানুষের ভরসা তো আছেই। এছাড়া যখন কোন সমস্যাপূর্ণ রোগী নিয়ে হাসপাতালে যাই তখন আমাকে ভরসা করে নার্সরা তাদের দায়িত্ব আমার উপর দিয়ে আমার পাশে অবস্থান করেন।”
কাজগুলো করতে পরিবার থেকে কি ধরনের সহযোগিতা পান জানতে চাইলে দেলোয়ারা বেগম বলেন, “পরিবার থেকে আমি সব ধরনের সাহায্য পেয়ে থাকি। কখনো কোন কাজে বাধা পাইনি। বরং এ কাজ করতে পরিবার থেকে আমাকে উৎসাহিত করা হয়। রাত-বিরাত কোন জায়গায় ধাত্রীর কাজে যেতে হলে পরিবার থেকে (কখনো ছেলে কখনো ছেলের বাপ) আমাকে পৌছে দিয়ে আসে।” তিনি আরো বলেন, “কোন কিছু পাওয়ার আশা থেকে আমি এ কাজ করিনা। আমি আমার দাদীর মতো করে একাজ নিজের থেকে অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে যেতে চাই।” এ সমস্ত কাজের মাধ্যমে তিনি যুক্ত হয়েছেন বারসিক, উত্তরণ, ব্র্যাক, জাগরণী চক্র, উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, জাতীয় মহিলা সংস্থার ন্যায় সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে। তার কাজের সম্মাননাস্বরূপ তিনি সম্প্রতি লাভ করেছেন ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার। ব্র্যাক থেকে ইউনিয়নের শ্রেষ্ঠ সেচ্ছাসেবক নিযুক্ত হয়েছেন। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের থেকে তার কাজের জন্য প্রশংসিত হচ্ছে।
এছাড়াও ২২ মার্চ ২০১৬ তারিখের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শ্যামনগর সদর ইউনিয়নের ১২৩নং ওয়ার্ডের মহিলা ইউপি সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হলে সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা বেড়ে যায় অনেকগুণ। ইতিমধ্যে তার কাজের একটি তালিকা করে ইউনিয়ন পরিষদে সাইনবোর্ড দেওয়া হয়েছে। দেলোয়ারা বেগম স্বপ্ন দেখেন আজীবন অসহায়, নীপিড়ীত মানুষের পাশে থেকে তাদেরকে সেবা দানের মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষকে সচেতন ও যোগ্য করে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার। দেলোয়ারা বেগম বলেন, “আমার এ কাজকে আরো গতিশীল ও মানুষের সেবায় নিয়োজিত রাখার জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে কোন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাজ করার কোন সনদপত্র পেলে আমার কাজটি আরো বেশি বিস্তার লাভ করবে এবং বেশি মানুষকে সেবা দিতে পারবো।” সেক্ষেত্রে বারসিকের কাছ থেকে এ ধরনের সূযোগ করে দেওয়ার জন্য তিনি অনুরোধ করেন।
স্থানীয় এই নারীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে তার কাজের বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি করলে গ্রামীণ নারী মুক্তি ও স্বাস্থ্য সচেতনতায় রাখতে পারে এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। কর্মএলাকায় গড়ে উঠা প্রতিটি জনসংগঠন তাদের সংগঠনের ও গ্রামের কেউ অসুস্থ হলে, কাউকে রক্ত দিতে হলে, ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন হলে, কোন টিকা দেওয়ার জন্য, চিকিৎসা ক্যাম্প, কর্মশালা, মতবিনিময়, আলোচনা ও দিবস পালনে স্ব স্ব অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন ও আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করছে। অনেক জনসংগঠন বছরে কতজনকে কি ধরনের স্বাস্থ্য সেবা দিচ্ছে তা তাদের সংগঠনের রেজিষ্টারে লিপিবদ্ধ করে রাখছেন।