কৃষাণি রেনু বালার কৃষি ভাবনা…
সিংগাইর, মানিকগঞ্জ থেকে অনন্যা আক্তার….
মাটি, পানি ও বাতাস প্রকৃতির এই তিনটি উপাদানকে ব্যবহার করেই এদেশের কৃষকরা শস্য উৎপাদন করেন। কৃষকের শ্রমে ঘামে উৎপাদিত সেই ফসল খেয়েই আমরা বেঁচে থাকি। খাদ্য শস্য উৎপাদনের সাথেই এখন পর্যন্ত দেশের অধিকাংশ মানুষ জড়িয়ে আছে, তাই তো আমাদের দেশ পরিচিত কৃষি প্রধান দেশ হিসেবে। বৈচিত্র্যময় ফসলের চাষ আর কৃষি কাজকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে গ্রামের মানুষের এক পারস্পারিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক। কিন্তু তথাকথিত আধুুনিক কৃষির নামে সেচ, সার, বিষ নির্ভর কৃষিচর্চা আমাদের গ্রামীণ জীবনের পারস্পারিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ককে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে। সেই সাথে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফসল উৎপাদনের প্রধান প্রাকৃতিক উপাদান মাটি, পানি ও বাতাস। কিন্তু আমাদের দেশের অনেক কৃষকই এই সমস্যাকে বুঝতে পেরে তা মোকাবেলা করতে লোকায়ত জ্ঞান চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। তাদের মধ্যে একজন আটকড়িয়া গ্রামের কৃষাণী রেণুবালা মজুমদার (৫৫)।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2024/04/unnamed.jpg)
মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার আটকড়িয়া গ্রামের কৃষাণী রেনুবালা মজুমদার। স্বামী-¯ত্রী, ছেলে ছেলের বউ আর নাতি নিয়ে ৫ জনের সংসার তাঁর। পরিবারের সবাই মিলে কৃষি চর্চা করে থাকেন। নিজের দেড় বিঘা জমির সাথে অন্য কৃষকের দুই বিঘা জমি বর্গা নিয়ে তিনি বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ করেন। ছোটবেলাায় বাবা মায়ের কাছ থেকে শেখা কৃষিই তার কৃষি কাজের মূল বিষয়। তিনি ও তাঁর পরিবার জমিতে ফসল চাষ করতে গিয়ে রাসায়নিক, কীটনাশক প্রয়োগ করেনা। রেণুবালা বলেন, ‘আমি আমার বাপ দাদার কাছ থেকে শেখা কৃষিই চর্চা করি, ফসল উৎপাদনে বাজারের কোন উপকরণ আমার তেমন প্রয়োজন পড়েনা, যা অনেকের কাছেই মনে হয় পুরানো কালের কৃষি। কিন্তু বর্তমানে অনেক কৃষকই দেখা যাচ্ছে ফসল চাষের ক্ষেত্রে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে জৈব সার ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করছেন।’ বারসিকের সাথে রেনুবালার পরিচয় ২০২১ সাল থেকে। বারসিক আয়োজিত বিভিন্ন প্রশিক্ষণে তিনি উপস্থিত থাকেন। তিনি বলেন, বারসিক’র আলোচনা থেকেও অনেক কৃষক জানতে ও বুঝতে পারছেন মাটি ও পানিকে নষ্ট করে ফসল উৎপাদন করা যাবেনা। কৃষকের বীজ কৃষকের কাছেই রাখতে হবে।’
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2024/04/unnamed-1.jpg)
রেনুবালা বলেন, ‘মাটি থেকেই তো সব ফসল হয়, সেই মাটিকেই যদি আমরা নষ্ট করে ফেলি তাহলে আমরা ফসল ফলাবো কিভাবে? তাই মাটিকে কোনভাবেই নষ্ট করা যাবেনা। আমি যেভাবে কৃষিচর্চাগুলো করি তা থেকে আমি যেমন উপকার পেয়েছি তেমনি বারসিক’র আলোচনাগুলো আমার সাহস বাড়িয়েছে। সার বিষ কিভাবে আমাদের মাটি, পানিকে নষ্ট করছে তা আমি এখন অনেক কৃষক কৃষাণীকে বুঝাতে পারি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বারসিক’র আলোচনাগুলোর মাধ্যমে আমি নিজে উপকৃত হয়েছি এবং প্রতিবেশীদের পরামর্শ দিয়েছি। বীজ হচ্ছে আমাদের মত কৃষকদের মূল শক্তি, তাই বীজকে আমাদের কাছেই রাখতে হবে। এটা বাজার থেকে কিনলে হবে না। আমরা কৃষক জমিকে ব্যবহার করে ফসল ফলাবো। বাজার হচ্ছে আমাদের উৎপাদিত ফসল বিক্রি করার জায়গা কিন্তু দেখো যাচ্ছে ফসল উৎপাদন করার জন্য সার বিষ কেনার জন্যই আমাদের অনেক বেশি বাজারে যেতে হয়। এসব জিনিসের দামও থাকে অনেক বেশি আবার এগুলো ব্যবহার করে আমরা নষ্ট করছি আমাদের মাটিকে। এটা থেকে আমাদের সকল কৃষককে বেরিয়ে আসতে হবে। তাহলেই কৃষি কাজ করে কৃষক লাভবান হবেন।’
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2024/04/unnamed-2-1024x662.jpg)
এই বছর রেনুবালার পরিবারের চাষকৃত ফসলের মধ্যে রয়েছে ধান, পাট, সরিষা, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, ফুলকপি, চালকুমড়া, ঢেড়স, পুইশাকস। এছাড়া তিনি নানা ধরনের সবজি ও ধনিয়া, কালোজিরা মসলা চাষ করেছেন। চাষকৃত ফসল পরিবারের খাদ্য চাহিদা পূরণ করে প্রায় ৪৫ হাজার টাকার ফসল বিক্রি করতে পেরেছেন।
রেনুবালা বলেন, ‘ফসলের নায্যমূল্য পাওয়া গেলে নিজস্ব পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করে কৃষক লাভবান হবেন। আমাদের বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ করতে হবে, যেহেতু আমাদের জমি কম তাই সারাবছর বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ করতে হবে। রাসায়নিক, কীটনাশকের পরিবর্তে জৈবি সার ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া সকল ধরনের বীজ নিজেদের বাড়িতে রাখতে হবে, যেন সময়মত যে জমির জন্য যে ফসল উপযোগি সেটা চাষ করা যায়। তাহলেই সব কিছু ঠিক রেখে আমাদের এলাকার কৃষি এগিয়ে যাবে।’