অচাষকৃত শাকের ফেরিওয়ালা

:: সাতক্ষীরা থেকে শাহীন ইসলাম

অচাষকৃত উদ্ভিদকোন প্রকার প্রকল্প ও কর্মসূচি ছাড়াই জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্যজগতের ব্যবহার, বিকাশ, সচেতনতা ও চর্চা বাড়ানোর মহান দায়িত্ব পালন করছেন সাতক্ষীরার যুবক বাবর আলী। বাংলাদেশের উপকূলীয় সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার সোভনালী ইউনিয়নের গোঁদাড়া গ্রামের যুবক বাবর আলী বলেন, “সবজি বিক্রি আমাদের জাত ব্যবসা। বাপ-চাচারা সবজি বিক্রি করতো। ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন শাক ও লতাপাতার সাথে আমার পরিচয়। বাপ-মার কাছ থেকে শিখেছি মানুষ যে সব শাক চাষ করে না তার নাম, ব্যবহার, মৌসুম ইত্যাদি। আমাদের চম্পাফুল বাজারে একজন কাকা বিভিন্ন খাল-বিল, ঝোপ-ঝাড় ও রাস্তার পাশ থেকে নানান রকম শাক কুড়িয়ে বাজারে বিক্রি করতো। ঐ কাকার কাছ থেকেও অনেক শিখেছি”।

বাবর আলীরা ৪ ভাই ও দুই বোন। পরিবারে অভাব লেগেই থাকতো। সেজন্য প্রায়ই তাদের মা কচু শাক, থানকুনি শাক, কলমি শাক, বেত শাক, তেলাকচু শাক তুলে এনে রান্না করতো। এর মধ্যে বোনদের বিয়ে হয়েগেছে। ভাইরাও আলাদা সংসার করে পৃথক হয়ে গেছে। বাবর আলীর ৩ ছেলেসহ ৫ জনের সংসার। এলাকায় দিন মজুরি করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। এই কষ্টের মাঝে একদিন তার স্ত্রী তাকে সাতক্ষীরা শহরে এসে সবজির ব্যবসা করতে পরামর্শ দেয়। এভাবে ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে পরিবারসহ  সাতক্ষীরা শহরের মিল বাজারের পাশে ঘর ভাড়া থাকতে শুরু করেন তিনি। প্রথমে তিনি সবজির ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু লাভ করতে পারছিলেন না। তার এক আত্মীয়কে দেখেন বুনো শাক তুলে শহরে ভ্যানে করে বিক্রি করতে। তাকে দেখে বাবর আলীও সাহসী হয় শাক ব্যবসা করার। পরিবারের সাথে কথা বলে একটি এনজিও থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটি ভ্যান, ঝুড়ি, কাচি কিনে অচাষ করা শাক তুলে বাজারে ফেরি করতে শুরু করেন তিনি। প্রতিদিন খুব সকালে উঠে নামাজ পড়ে ভ্যান ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে শাক তুলতে বের হন। প্রথমে পানির শাকগুলো যেমন কলমি, শাপলা, সঞ্চি শাক তুলেন। কারণ সকালে পানি পরিস্কার থাকে। তিনি বলেন, “অনেক সময় হাঁটু পানি, মাজা পানি, কোমর পানি-এমনকি ডুব দিয়েও পানির শাক তুলতে হয়। পানির শাক উঠানো হয়ে গেলে সমস্ত শরীর মুছে গায়ে ফিটকিরি পানি মাখি। শরীর শুকিয়ে গেলে সরিষার তেল মাখি। এরফলে গায়ে চুলকানি, ঘাঁ হতে পারে না। এরপর অন্যান্য শাক উঠানো শুরু করি। সব শাক এক জায়গায় পাওয়া যায় না। এক এক স্থান থেকে এক এক ধরনের শাক পাওয়া যায়। এভাবে প্রতিদিন নানা রকম শাক তুলে দুপুর বেলা বাড়ি ফিরি।”

আসরের নামাজ পড়ে শাকের ভ্যান নিয়ে বিক্রির জন্য শহরে বেরিয়ে পড়েন তিনি। রাত ৯/১০ টার মধে সমস্ত শাক বিক্রি হয়ে যায় তার। ১০০ গ্রাম থানুকুনি শাক ১৫ টাকা, এক আঁটি কচু শাক ১০/১৫ টাকা ও অন্যান্য শাক ৫/১০ টাকা আঁটি বিক্রি করে দৈনিক ৫০০/৬০০ টাকা আয় করেন। এভাবে সাতক্ষীরার কদমতলা, দেবনগর, বিনেরপোতা, ৩০ মাইল, নগরঘাটা, নিমতলা, মৌলবির বাজার, ধানদে, জয়নগর, ভৈরবনগর, আসামনগর, পাটকেলঘাটা, খলিষখালী, কুমিরা, ধুলিহর, আলিপুর, তালতেতলাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে কলমি, থানকুনি, সঞ্চি, মালঞ্চ, ঘেটকুল, কুলফি, তেলাকচু, কচু শাক, পেপুল, হেলাঞ্চ, বিরমি, বউটুনি, কাঁটানটে, বেতশাক, গাদমনি, কাঁথাশাক, বুনোবেগুন, ডুমুর, কলার মোচা, থোড় ও বুনোআমড়া সংগ্রহ করে বিক্রি করতে শুরু করেনে। এ সমস্ত শাকে কোন বিষ ও সার দেওয়া না। প্রাকৃতিকভাবে জন্ম হয়। প্রতিটি শাকের উপকারী ও ঔষধি গুণাবলী আছে।

অচাষকৃত উদ্ভিদশহরে অনেকে বাবর আলীর কাছ থেকে শাক নেওয়ার জন্য বসে থাকে। অনেক দোকানে নিয়মিত শাক দিতে হয় তার। সবাই তার কাজকে পছন্দ ও প্রশংসা করে, অনেকে তার সন্তানের মত ভালোবাসে বলে তিনি জানান। তার নিজের ভাললাগা এটাই যে তিনি মানুষকে বিষ ও সার মুক্ত প্রাকৃতিক জিনিস খাওয়াতে ও চেনাতে পারছেন। সাতক্ষীরা শহরে বাসা ভাড়া করে মোটামুটি ভালো আছেন বর্তমানে। দুই ছেলে স্কুলে যায়। তার স্ত্রী ও বড় ছেলে নানানভাবে সহযোগিতা করে। এই প্রসঙ্গে বাবর আলীর স্ত্রী মাজিদা বেগম বলেন,“খুব সকালে উঠে উনাকে শাক তুলতে যাওয়ার জন্য ডেকে দেই। সংসারের কাজের পাশাপাশি আমিও শাক ধোয়া, কাটা, আঁটি বাঁধা, শাক বাঁধার দড়ি তৈরী করা, ভ্যানে শাক সাজানো ও অনেক সময় আশপাশের এলাকা থেকে কিছু কিছু শাক তুলে আনি”।

তবে বর্তমান সময়ে প্রতিটি ঋতুর সাথে কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য জগতের সম্পর্কটি ক্রমে ক্রমে বদলে যাচ্ছে। ঋতুর যেমন বদল ঘটছে, তেমনি হারিয়ে যাচ্ছে কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্যের বৈচিত্র্য। প্রাণবৈচিত্র্যের প্রতিটি সদস্যই প্রকৃতিতে তার নানান সংকেত ও নির্দেশনা জানান দেয়। বাংলাদেশের অনেক আদিবাসী ও গ্রামীণ সমাজ মনে করেন বর্ষার শুরুতে ঘনঘন বজ্রপাত হলে মাটি ফুঁড়ে খাদ্য উপযোগী বুনো মাশরুম বের হবে। প্রথম বৃষ্টির পরপরই মাটি ফুঁড়ে বের হয় বুনো আলুর নতুন শাখা। আবার শীতকালে কেবল লতা রেখে ঝরে যায় সব পাতা।  বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় প্রাকৃতিক এসব খাদ্যউৎসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।

খাদ্য কেবল পেট ভরায় না, এটি পুষ্টি, শক্তি, সংস্কৃতি, স্থানীয় প্রতিবেশের সাথে গ্রামীণ জনগণের সম্পর্ককেও তুলে ধরে। গ্রাম জনপদের মানুষের কাছ থেকে তার খাদ্যভান্ডার কেড়ে নিয়ে দশাসই যেসব খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি প্রকল্প বারবার গ্রহণ করে তা কোনোভাবেই দেশের সকল জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না। জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিজস্ব কৌশল ও রীতিগুলোকে গুরুত্ব ও স্বীকৃতি দেয়া জরুরী। নতুন প্রজন্মের ভেতর কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্যজগৎ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও খাদ্য হিসেবে তা গ্রহণ করার চর্চা বাড়ানোর মাধ্যমেই তা সম্ভব হয়ে ওঠবে।

অচাষকৃত শাকপাতা, লতা গুল্ম, ঔষধি উদ্ভিদ বৈচিত্র্যই গ্রামীণ জনপদের পুষ্টির অন্যতম উৎস। প্রকল্প আর কর্মসুচি বাস্তবায়ন নয়, এসব উদ্ভিদ সংরক্ষণ উদ্যোগ-ই প্রধান ভূমিকা রাখবে গ্রামীণ জনপদের পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তায়। বুঝে হোক আর না বুঝে হোক জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে সেই মহান কাজটি করছেন অচাকৃত শাক ব্যবসায়ী সাতক্ষীরার যুবক বাবর আলী ও রুহুল আমিন।

happy wheels 2

Comments