পরিবেশ রক্ষা ও জ্বালানি সাশ্রয়ে অবদান রাখছে বন্ধু চুলা
:: রাজু আহমেদ, বারসিক, রাজশাহী::
বর্তমান বিশ্ব যত উন্নতির দিকে যাচ্ছে পৃথিবীর জন্য সেটি ততো বেশি হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রতিনিয়ত পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের চাহিদা এবং পরিবর্তন আসছে মানুষের দৈনন্দিন জীবন ব্যবস্থাতেও। পরিবর্তিত এই সময়ে মানুষের চাহিদাগুলো পূরণ করতে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে শিল্পের প্রসার। এই শিল্পগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে জ্বালানি যার সিংহভাগই আসছে জ্বালানির জীবাশ্ম উৎস থেকে। ফলে এই জ্বালানিগুলো যত বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে আমাদের চারপাশের পরিবেশকে সেটি ততো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কারণ এই ধরনের জ্বালানিগুলো থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ও মিথেনের মত ক্ষতিকারক গ্যাস নির্গমন হয় যা পরিবেশ বিপর্যয়ের একটি মূল কারণ। ফলে টেকসই উন্নয়নের যে ধারণা সেটির সাথে এটি পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। এটি ছিল বড় পরিসরে পরিবেশ বিপর্যয়ের একটি কারণ। আমরা যদি ছোট পরিসরে চিন্তা করি তাহলে দেখা যাবে যে, আমারা বাড়িতে রান্নার জন্য যে চুলা ও জ্বালানি ব্যবহার করি সেটিও কিন্তু পরিবেশের ক্ষতি করে। আমাদের দেশে এই ধরনের চুলা ব্যবহারকারী পরিবারের সংখ্যা কম নয়। বর্তমানে দেশে সনাতন পদ্ধতির চুলা ব্যবহার করে প্রায় ৩ কোটি পরিবার (দৈনিক ইনকিলাব, ৪ এপ্রিল ২০১৫)। এই পরিসংখ্যান দেখে এটি সহজেই অনুমান করা যায় যে, প্রতিদিন কি পরিমাণে ক্ষতিকারক গ্যাস ধোঁয়ার মাধ্যমে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে। একটি চুলা যে শুধুমাত্র পরিবেশের সাথে সম্পর্কিত তা নয়, এটির সাথে একটি পরিবারের অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত দিক জড়িত রয়েছে। পরিবারের আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রতিদিন এই চুলার জ্বালানির পেছনে ব্যয় করতে হচ্ছে। পাশাপাশি যারা এই চুলার পাশে বসে থেকে রান্না করেন তাদের বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
পরিবেশ এবং বন্ধু চুলা
পরিবেশের ক্ষতি করে কখনও টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। টেকসই বা স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন তখনই নিশ্চিত করা সম্ভব যখন আমারা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে উন্নয়নকে তরান্বিত করবো। কেননা, মানুষ একাকী কখনও বেঁচে থাকতে পারে না। তারা আশেপাশের পরিবেশে যা কিছু আছে তার সবগুলোকে নিয়েই তাকে বেঁচে থাকে। এখানে একটি গাছের যেমন প্রয়োজন আছে তেমনি একটি পাখিও প্রয়োজন আছে। এর সবকিছুই পরিবেশের উপাদান। তাই পরিবেশ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবে এর উপাদানগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেইসাথে ক্ষতিগ্রস্ত হব আমরা। কারণ আমরাও পরিবেশের বাইরের কোন উপাদান নয়। আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই পরিবেশের দিকে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে এবং সেই অনুযায়ী আমাদের কার্যক্রমগুলোকে সাজাতে হবে।
বারসিক পরিবেশবান্ধব কাজের অংশ হিসাবে ২০১২ সালে নাচোলের বরেন্দা গ্রামে ১২ প্রকারের চুলা নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করে। কোন চুলায় জ্বালানি বেশি লাগে, কোন চুলায় কম লাগে, কোন চুলায় সময় বেশি লাগে, কোন চুলায় সময় কম লাগে, কোন চুলার পাশে বসে থাকলে শরীরে তাপ বেশি ও কম লাগে এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনটিতে কি পরিমান ধোঁয়া নির্গত হয় এই বিষয়গুলো জানার জন্যই মূলত গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়েছিল। গবেষণাকৃত চুলার মধ্যে একটি অন্যতম চুলা ছিল বন্ধু চুলা যেটির আবার দুটি ভাগ ছিল। একটি সিমেন্টের তৈরি আর একটি মাটির তৈরি। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে, অন্যান্য চুলার তুলনায় বন্ধু চুলায় ধোঁয়া নির্গমনের পরিমাণ কম এবং রান্নাও অপেক্ষাকৃত দ্রুত হয়। এর একটি কারণ হল, এর আকার। এই চুলায় প্রচলিত অন্যান্য চুলার মত কোন ঝিক থাকে না; ফলে চুলা এবং রান্নার উপকরণের মধ্যে কোন ফাঁকা অংশ থাকে না। এই কারণেই তাপ কোন দিক দিয়ে বের হয়ে যেত পারে না যেটি অন্যান্য চুলার ক্ষেত্রে ঘটে। যেহেতু তাপ কোন দিক দিয়ে বের হতে পারে না সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই রান্নাও দ্রুত হয়। এই চুলাই রান্নার সময় কম লাগায় জ্বালানি খরচও কম হয়, যা কম ধোঁয়া নির্গমনে ভূমিকা রাখে যেটি আবার প্রত্যক্ষভাবে কার্বন নিঃসরণের পরিমান কমিয়ে দেয়।
এই চুলার আর্থিক দিক যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে, এটি অনেকটা জ্বালানি সাশ্রয়ী একটি চুলা। পুকুরিয়া পাড়ার নারীদের তথ্য মতে, সাধারণ চুলায় একবার ভাত রান্না করতে ৬টি ঘুটার (গোবরের তৈরি এক প্রকার জ্বালানি) প্রয়োজন হয় যার প্রতিটির মূল্য ২ টাকা। অপরদিকে, বন্ধু চুলায় রান্না করলে প্রতিবার ৪টি ঘুটার প্রয়োজন হয়। ফলে প্রতিবার শুধু ভাত রান্নায় ৪ টাকা করে সাশ্রয় হয় অর্থাৎ এক তৃতীয়াংশ জ্বালানি এবং অর্থ উভয়ই সাশ্রয় হচ্ছে। আবার ব্যতিক্রমও আছে, কেউ কেউ এটিও বলেছেন যে, অন্যান্য চুলা এবং এই চুলায় সমান পরিমাণ জ্বালানি লাগে। এর কারণ পুকুরিয়া পাড়ার বন্ধু চুলার কারিগর নাইমা বেগম বলেন, চুলা তৈরির পরে যদি সেটি সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা না হয় বা চুলাটি যদি সঠিকভাবে তৈরি করা না হয় তাহলে এই সমস্যাটি হয়ে থাকে। ফলে এখানে কারিগরের দক্ষতারও একটি বিষয় রয়েছে। কারিগর যদি দক্ষ হয় তাহলে চুলা ভালো হবে এবং মানুষ এর পুরো সুফল ভোগ করতে পারবে।
বন্ধু চুলা তৈরিতে নারীদের আগ্রহ
নাচোলের বরেন্দ্রা গ্রামের নৌবাহার বেগম যে চুলা তৈরি করেন সেটি দেখতে বন্ধু চুলার মতোই যদিও এটিতে কোন পাইপ ব্যবহার করা হয় না। এই বন্ধু চুলার প্রসারের জন্য তাই বারসিক এই নৌবাহার বেগমকে বেছে নেয় যাতে তিনি অন্য নারীদেরকেও বন্ধু চুলা তৈরিতে প্রশিক্ষণ দিতে পারেন। নৌবাহারকে আরও দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য বারসিক তাকে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলে। নৌবাহার বেগম চুলা তৈরির দক্ষতা অর্জনের পর তিনি তার গ্রামে বিভিন্ন নারীকে হাতেকলমে শিক্ষা দেন কীভাবে তারা এই চুলা তৈরি করে ব্যবহার করতে পারেন। তিনি নিজেও অনেক বাড়িতে এ ধরনের চুলা তৈরি করেছেন। এ ক্ষেত্রে যারা চুলা তৈরি করিয়ে নেন তাদেরকে শুধুমাত্র পাইপ ও পাইপের টুপি ২০০ টাকা দিয়ে বাজার থেকে ক্রয় করতে হয়। এখন পর্যন্ত বরেন্দা গ্রামে ৩৯টি পরিবার এই ধরনের চুলা তৈরি করিয়ে নিয়েছে এবং এটি এখনও চলমান রয়েছে। নৌবাহার বেগম পুকুরিয়া পাড়ার নাইমা বেগমকে চুলা তৈরি করার কৌশল শিখিয়ে দেন। এরপর নাইমা বেগম নিজে তার গ্রামের ২৭টি পরিবারে জন্য এ ধরনের চুলা তৈরি করেছেন স্বল্পমূল্যে (২০০ টাকা)। বর্তমানে নাইমা বেগম শুধুমাত্র তার গ্রামেই নয় অন্যান্য গ্রামে গিয়েও একই পদ্ধতিতে চুলা তৈরি করে দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত বরেন্দা গ্রামে ৩৯টি, পুকুরিয়া পাড়ায় ২৭টি, টিকোইল গ্রামে ১০টি, খড়িবোনা গ্রামে ৭টি এবং অন্যান্য গ্রামে ১৫ টি চুলা তৈরি করা হয়েছে।
উপসংহার
একটি বন্ধু চুলা বছরে ১.৭ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড কম উৎপাদন করে (ইনকিলাব, ৪ এপ্রিল ২০১৫)। নাচোলে এ পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রামে যে ৯৮টি বন্ধু চুলা তৈরি করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রতিবছর একটি বন্ধু চুলার কার্বন নিঃসরণের হার হিসাব করলে দেখা যাবে যে, এই ৯৮টি চুলা ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রামের নারীরা অন্তত প্রতিবছর ১৬৬.৬ টন কার্বন কম উৎপাদন করছে। তাই যদি বাংলাদেশের যদি প্রতিটি পরিবার এই বন্ধু চুলা ব্যবহার করে তাহলে দেখা যাবে যে, অনেকবেশি কম কার্বন নির্গত হবে। এতে করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হবে। তাই পরিবেশকে যদি আমরা সুরক্ষিত রাখতে চাই এবং সত্যিকারের টেকসই/স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন দেখতে চাই তাহলে আসুন আমরা ক্ষুদ্র পরিসর থেকেই আমাদের পরিবেশ সুরক্ষার উদ্যোগগুলো শুরু করি। বন্ধু চুলা ব্যবহারসহ অন্যান্য পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ নিতে অন্যান্যদের উৎসাহিত করি।