সাম্প্রতিক পোস্ট

ওষধি বাগানে স্বাবলম্বী এক পরিবার

 লোকজ বটিয়াঘাটা খুলনা থেকে মিলন কান্তি মন্ডল

খুলনা-নলিয়ান মহাসড়কের ১৮ কি.মি দক্ষিণে এবং সুন্দরবন থেকে ২৫ কি.মি উত্তরে খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার গঙ্গারামপুর ইউনিয়নের কাতিয়ানাংলা গ্রামের ২ কন্যা সন্তানের জনক মো: আইয়ুব আলী (৪৫) ও  নাজনীন আক্তার (৩৮) দম্পতি ২ বিঘা জমির ওপর  প্রায় ২০৫০ প্রজাতির ঔষধি গাছ নিয়ে গড়ে তুলেছেন “জিনিয়া ঔষধি বাগান” যা স্থানীয় এলাকায় কবিরাজ বাড়ি নামে পরিচিত।

1
দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা আইয়ুব আলী বাবা মারা যাওয়ার পর অনটনের কারণে লেখাপড়া আর  চালাতে পারেননি। ১৯৯৩ সালে খুলনা মহানগরীর রায়ের মহল এলাকার নাজনীন আক্তারে সাথে বিয়ের পর শুরু করেন কৃষিকাজ। পাশাপাশি তিনি দর্জিরও কাজও করতেন। কখন ও বেশি উপার্জনের আশায় ট্রলার নিয়ে সুন্দরবন ও সাগরে যেতেন মাছ ধরতে। কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় আইয়ুব আলীকে এই কাজে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়তে হয়। উচ্চ মাধ্যমিক পাস নাজনীন সংসারের বাড়তি উপার্জনের জন্য বাড়িতে থেকেই দর্জির কাজ ও ছোট বাচ্চাদের জন্য টিউশনি করাতেন। এই দম্পতি জানান, ১৯৯৮ সালে বাড়িতে ডাকাতি হলে তারা সর্বশান্ত হন। তখন  অভাব যেন তাদের  আরও আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে।

প্রাত্যহিক জীবনে তখন অভাব-অনটন নিত্যসঙ্গী হলেও এই দম্পতি মনের মধ্যে এক নতুন স্বপ্ন নিয়ে এগুতে থাকেন। এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে ২/১টি করে ঔষধি গাছ এনে বাড়িতে লাগাতে থাকেন। বাবুই পাখির বাসা বানাবার মতো নিরবে চলতে থাকে তাদের গাছ সংগ্রহ, রোপণ ও পরিচর্যার কাজ। মাঝে মধ্যে আইয়ুব আলী ঐসব গাছের শিকড়, বাকল, পাতা দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেন। কিছুদিন পর আইয়ুব আলী আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা বিষয়ে শর্ট কোর্স সম্পন্ন করেন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তাদের ঔষধি গাছ সংগ্রহের আগ্রহ ও উদ্দীপনা। তাদের গাছ সংগ্রহের এই কাজকে স্থানীয় অনেকেই পাগলামি বলে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু তাদের ধারণাই ছিলোনা যে, এই ঔষধি গাছ ও এর শিকড়, বাকল, পাতা, ফুল, ফল দিয়েই একটি সংসার ভালোভাবেই পরিচালনা সম্ভব। এমনকি অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল এক নতুন জীবন।

প্রতিবেশীদের অনেকেই আইয়ুব-নাজনীন দম্পতির ঔষধি বাগানের এই কাজকে নিরুৎসাহিত করলেও স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা “লোকজ” তাদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সহযোগিতা করেছে। কথা প্রসঙ্গে আইয়ুব আলী জানালেন, লোকজ  মাটির  টব, বাগানে পানি সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেছে। পাশাপাশি সরকারি দপ্তর, কৃষিবিভাগ, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সাংবাদিক, প্রচার মাধ্যমের সাথে পরিচয় ও যোগাযোগ স্থাপনে সহযোগিতা করে পাশে থেকেছে।
2
বিগত ৩ মার্চ, ২০১৭ তারিখে ঔষধি বাগান পরিদর্শনকালে আইয়ুব আলী বলেন, “বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের কবিরাজ, হাকিম, সাধুগুরুদের চাহিদার ভিত্তিতে তিনি এই ঔষধি বাগানটিতে দূুর্লভ রিষ্মগন্ধা, বৃহদাকার, নাগেশ^র, তেজবল, হলুদবাসক, লক্ষ্মনা, হন্তিকর্ণ, শে^তপলাশ, মহুয়া, আলু বোরখা, মনজিষ্টা, ত্রিশুল, অশ^গন্ধা, স্বর্পগন্ধা, গন্ধনাবুলি, জাতিপুষ্প, বিসল্লাকরণীসহ অনেক মহামূল্যবান গাছ লাগিয়েছি।” তিনি ভারত থেকে এই সব গাছ এনেছেন। কোরিয়া থেকে এনেছেন জিনসেন, মালয়েশিয়া থেকে রাম্বুতান এবং দেশের মধ্যে থেকে রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার, পাহাড়তলী, খাগড়াছড়ি, ময়মনসিংহ, ঈশ^রদী, টাঙ্গাইল, ঢাকা, গাজীপুর থেকে বহু গাছ সংগ্রহ করেছেন। আর সুন্দরবন থেকে সংগ্রহ করেছেন খলিশা, পশুর, ধুন্দল, বাওয়ালী লতা ও আমড়া গাছ। এই সব গাছের উপযোগিতা সম্পর্কে তিনি জানান, আযুর্বেদ একটি চিকিৎসা শাস্ত্র যার মাধ্যমে অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা সম্ভব। জন্ডিস, চর্মরোগ, বাতব্যাধি, অশ^, ভগন্দর, টিউমার ও দন্ত রোগ চিকিৎসা সম্ভব বলে তিনি দাবি করেন। তার চিকিৎসায় এ পর্যন্ত  ৯ জন নিঃসন্তান দম্পতি সন্তান লাভ করেছেন। তার সংগ্রহে আছে আয়ুর্বেদ সংগ্রহ, আইয়ুর্বেদ শিক্ষা, কবিরাজি শিক্ষা, চিকিৎসা দর্শন, বৈষয্যরতœাবলী, চড় সংহীতা, মুক্তাবলী, দ্রব্যগুণ অভিধান, পাঁচন সংগ্রহ, আদিআসল লোকমান হাকিমী, চিরঞ্জীব বনৌষধী ১১ খ-সহ  শত বছরের পুরাতনসহ দুর্লভ মহামূল্যবান ১০০ টিরও বেশি গ্রন্থ।

আইয়ুব-নাজনীন দম্পতির এই “জিনিয়া ঔষধি বাগান” বর্তমানে স্থানীয় এলাকায় শিক্ষার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। খুলনা ইউনানী মেডিকেল কলেজও খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের ফরেষ্ট্রি এন্ড উড টেকনলজি ডিসিপ্লিন তাদের শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক ক্লাশের অংশ হিসেবে এই বাগানটি পরিদর্শন করে। ঔষধি বাগানে যাতায়াতের সুবিধার জন্য উপজেলা পরিষদ ওয়াপদা রাস্তা থেকে বাগান পর্যন্ত ইটের তৈরি বিছিয়ে দিয়েছে বলে জানালেন আইয়ুব।
3
আইয়ুব-নাজনীন দম্পতি ঔষধি বাগান সংলগ্ন একটি ফুলের বাগানও গড়ে তুলেছেন। কাতিয়ানাংলা বাজারে নিজ মালিকানাধীন জায়গায় বানিয়েছেন বিক্রয় কেন্দ্র। বানিয়েছেন টিনশেডের আধা পাকা বসত বাড়ি। এই বাগান থেকে তাদের মাসিক আয় প্রায় ৩০ হাজার টাকার বলে জানান। এই দম্পতির দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে জিনিয়া আক্তার মীম খুলনা ইউনানী মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আর ছোট মেয়ে আরিফা আক্তার আঁখি নবম শ্রেণীতে অধ্যায়নরত। নাজনীন জানান, সারাদিন তার বাগানেই কাটে, অবসর বলে কিছু। স্বামীর এনে দেওয়া গাছ বাগানে লাগিয়ে পরিচর্যা করেন। যখন কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা  বাগানে আসে তখন আনন্দ আর তৃপ্তিতে মন ভরে ওঠে। তাদের বাগান নিয়ে এ পর্যন্ত  ইংরেজি ও বাংলা ভাষায়  বহু সংবাদ, ফিচার ইত্যাদি  প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে  প্রচারিত হয়েছে।

অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার পাশাপাশি “জিনিয়া ঔষধি বাগান” এই দম্পতির সামাজিক মর্যাদাও বাড়িয়েছে। নাজনীন আক্তার তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। সদস্য হিসাবে মনোনীত হয়েছেন গঙ্গারামপুর ইউনিয়ন পরিষদের কৃষি বিষয়ক ষ্ট্যান্ডিং কমিটি ও খুলনা বিভাগীয় বন কমিটিতে। আইয়ুব আলীকে স্থানীয় রাসমোহন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় তার ম্যানিজিং কমিটির সদস্য মনোনীত করেছে।  এই দম্পতি “জিনিয়া ঔষধি বাগান”কে আরও বিস্তৃত পরিসরে বাড়িয়ে এটিকে শিক্ষনীয় ও দর্শনীয় স্থান হিসেবে গড়ে তুলতে চান। বড় মেয়েকে ইউনানী ও আয়ুর্বেদীয় শিক্ষায় পড়িয়ে জনসেবায় নিয়োজিত করার আশা রাখেন। পাশাপাশি এই দম্পতির  নিজ বাড়ির আঙ্গিনাতেই  ভবিষ্যতে একটি ফ্রি চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র  গড়ার প্রত্যাশা রয়েছে।

happy wheels 2

Comments