নেত্রকোনা রেল কলোনীর জরিনা বেগমের শিক্ষার দ্বীপ শিখাটি মশালের রূপ নিক
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
নেত্রকোনা জেলা সদরের বড় রেল স্টেশনের পাশে গড়ে ওঠা রেল কলোনীর অবস্থান। মুসলিম, হিন্দু, মুচিসহ ভিন্নি ভিন্ন পেশা ও ধর্মাবলম্বীর প্রায় দুইশত পরিবারের বসবাস মাঝারি আকারের এই রেল কলোনীতে। কলোনীর অধিকাংশ পুরুষ সদস্যরা দিনমজুর, কুলি, চা বিক্রেতা, ফেরিওলা, নাপিত, ঢোল বাদকসহ বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত। নারীদের কেউ কেউ ঢাকার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। সরকারি খাস জমিতে দিনের পর দিন ও বছরের পর বছর এক ধরনের ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে রাত কাটছে পরিবারগুলোর, কখন আবার বাড়ি ছাড়ার নোটিশ আসে।
রেল লাইনের পাশের ছোট পিঠার দোকানটি কলোনির বাসিন্দা জরিনা বেগমের। মৌসুম ভেদে সারাবছর পিঠা বিক্রি করেন জরিনা বেগম। তবে শীত মৌসুমে দোকানটিতে সকাল ও সন্ধ্যা মানুষের ভিড় লেগেই থাকে সুস্বাদু খেঁজুর গুড়ের ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা ও চই পিঠা খেতে। দোকানটির পাশ দিয়ে হেটে চলার সরু রাস্তা দিয়ে যাওয়া পথচারীদের শীতের সকালে খেঁজুর গুড় আর নারকেল দিয়ে বানানো পিঠার মিষ্টি গন্ধ একবার হলেও আকর্ষণ করে দোকানটিতে। অত্যন্ত যত্ন করে একজন মায়েদের মত করে পিঠা তৈরি করেন জরিনা বেগম। পিঠা কিনতে গিয়ে প্রথম কথা হলো জরিনা বেগমের সাথে। ‘আপা কত বছর যাবত পিঠা বিক্রি করছেন? কয় ছেলে-মেয়ে আপনার? পিঠা বানানো বন্ধ করে সোজা হয়ে বসেন এবং সগর্বে বলেন,“আমি আজ থেকে প্রায় বিশ বছর যাবত পিঠার ব্যবসা করছি। আমার দুই ছেলে এক মেয়ে, ছেলে অনার্স পড়তাছে, মেয়ে এসএসসি দিব, আর ছোট ছেলে আষ্টম শ্রেনীতে পড়ে”। পিঠা নিয়ে তাড়া হুড়া করে চলে আসব ভেবেছিলাম কিন্তু থেকে গেলাম আমার পরিচিত রেল কলোনীর একজন নারীর গর্বিত মুখের ছবিটি তোলার জন্য এবং ছবি নিলাম আমার মোবাইল ফোনের ক্যামেরায়।
জরিনা বেগম পিতা পেশায় একজন বার্বুচি। ছোটরবলা থেকে জরিনা বেগম লেখাপড়ায় আগ্রহী ছিল, স্বপ্ন ছিল উচ্চ শিক্ষার। কিন্তু দরিদ্র পিতা-মাতার কাছে মেয়ের পড়াশুনার ইচ্ছা কোন গুরুত্ব পায়নি। অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালীন সময়ে এক দরিদ্র চা বিক্রেতা মনজুল মিয়ার সাথে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে শিক্ষার আলোহীন রেল কলোনীর অস্থায়ী জায়গায় তারা স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। শিক্ষার আলোহীন রেল কলোনীর সকলের জীবনধারা প্রায় একই রকম।
সন্ধ্যায় মুসলিম পরিবারের কিশোর বয়সি ছেলেরা উচ্চস্বরে হিন্দি ও বাংলা গান বাজানোয় ব্যস্ত, ঢুলি পরিবারগুলো সকালে ও সন্ধ্যায় ঢোল বাজানোয় ব্যস্ত। প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া লেগেই থাকে, এমনকি মারামারি পর্যন্ত হয়ে থাকে, যুবকদের অধিকাংশই বিভিন্ন নেশায় আসক্ত। প্রতিদিনই কলোনীর বিভিন্ন স্থানে চলে নেশার আড্ডা। বস্তি বা কলোনীর চিত্র সাধারণত এমনি হয়ে থাকে, কিন্তু জরিনা বেগম কিছুতেই এ জীবন মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি বুঝতে পেরেছেন কলোনীর এই চিরাচরিত চিত্র বদলাতে হলে কলোনীর মানুষের শিক্ষার প্রয়োজন। তার এ চিন্তা কলোনীর অভিভাবকদের বুঝাতে না পারলেও প্রথম সন্তানের মা হওয়ার পর তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, হাজার সমস্যা থাকলেও সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবেন। স্বপ্ন আর ভাগ্য সব সময় সমান তালে চলেনা। ছেলে-মেয়ে স্কুলে ভর্তির আগেই স্বামীকে চায়ের ব্যবসা ছাড়তে হলো স্টেশনে নতুন নতুন দোকান হওয়ায়। চা বিক্রি করে সারাদিনে যা আয় হয় সন্ধ্যায় আর তার হিসেব মিলেনা। দিন দিন ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে। সংসারে এমন অবস্থায় শক্ত হাতে হাল ধরলেন জরিনা। মায়ের কাছ থেকে শেখা পিঠা তৈরি করে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
রাত জেগে ঢেকিতে চালের গুড়ো তৈরি করে সকালে স্টেশনের এক কোণায় বসে পিঠা তৈরি করে বিক্রি করতে আরম্ভ করেন। এ ব্যবসার অন্যতম উপকরণ হল চালের গুড়ো ও লাকড়ি। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “বিশ বছর আগে লাকড়ির কোন সমস্যা ছিল না। কলোনীর আশপাশে গাছ-গাছালির ঝোঁপ ঝাড় ভরা ছিল, সেখান থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করেছি, খুব বেশি প্রয়োজন হলে রেলক্রসিং বাজার থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করতাম।” তিনি আরও বলেন, “আগে নেত্রকোনা বিভিন্ন জায়গায় লাকড়ির হাট বসতো, যা স্থানীয়ভাবে লাকড়ি মহল হিসেবে পরিচিত ছিল, বর্তমানে লাকড়ির একটি দোকানও নেই।” তিনি লাকড়ির জন্য নিজের বাড়িতে খুব অল্প জায়গায় বিভিন্ন ধরনের গাছ রোপণ করেছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন,“সরকারি জায়গায় গাছ লাগাইতে দেয়না, আমি লাগাইচি, গাছ সরকার নিলেও ডালগুলো আমি ব্যবহার করতে পারতাছি”।
পেশাটি টিকিয়ে রাখতে লাকড়ি সংগ্রহ করতে হয় বিভিন্ন কাঠের মিল থেকে, বাড়িতে পালিত গরুর গোবর শুকিয়ে জ্বালানির তৈরি (গুটি) করেন তিনি নিজেই। অনেক সমস্যার মধ্যেও খুব অল্প সময়ে জরিনা বেগমের তৈরি পিঠা রেলে ভ্রমণের জন্য স্টেশনে আসা মানুষের এবং চার পাশ্বের পরিবারগুলোর সকাল সন্ধ্যার নিয়মিত খাদ্য তালিকায় স্থান করে নিতে সক্ষম হয়। প্রতিদিন প্রায় ১০ থেকে ১৫ কেজি চালের পিঠা তৈরি করে তিনি বিক্রি করেন এবং এর আয় দিয়েই পরিবারের পাঁচ সদস্যের খাবার ও তিন সন্তানের লেখাপড়ার ব্যয়ভার চালাতে হয় অনেক কষ্টে জরিনা বেগমকে। বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে স্বামীকে একটি গরু কিনে দেন তিনি। স্বামী-স্ত্রী মিলে পরম যতেœ সেই গরু প্রতিপালন করায় একটি গরু এখন তিনটি গরুতে পরিণত হয়েছে। ২০ বছরে একবারের জন্যও পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ঘরের হাড়িতে চাল না উঠলেও তিন ছেলেমেয়ের পড়ার বই-খাতা কিনতে ভূল করেননি কখনও।
জরিনার কষ্টের ফল হলো রেল কলোনীতে প্রথম কোন ছেলে (তার বড় ছেলে) অনার্স পড়ছে। যারা একসময় জরিনা বেগমকে সন্তানদের পড়াশুনা করাচ্ছেন বলে উপহাস করে বলতেন,“পড়ানোর চেয়ে কাজে লাগায়া দেও রোজ ১০০ টাকা আয় করবো”। আজ তারা জরিনার দেখাদেখি তাদের সন্তানদের পড়াশুনা করাচ্ছে। জরিনা বেগমের গর্বিত মুখ সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর ক্ষেত্রে আগ্রহী করে তুলেছে। শিক্ষার যে দ্বীপ শিখা তিনি নিজে হাতে তুলে নিয়েছিলেন আজ কলোনীপাড়ার অনেক পরিবারের সন্তানদের মধ্যে তা খুব ধীর গতিতে হলেও ছড়িয়ে পড়েছে। কলোনীর অনেক ছেলে-মেয়ে এখন নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে। এ বছর প্রায় ৬ জন ছেলে-মেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।
কেরোসিনের আলোয় জ্বালানো যে দ্বীপ শিখাটি জরিনা বেগম একদিন একা হাতে বহন করছিলেন, সে দ্বীপ শিখাটি ধরে রাখতে কলোনীর অনেক পিতা-মাতা হাত বাড়িয়েছেন। আশা করি জরিনা বেগমের স্বপ্ন একদিন বাস্তবে পরিণত হবে এবং তার সন্তানেরা সত্যিকারের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। আলোকিত করবে জরিনা বেগম ও স্বামীর মূখখানা। তাঁর মতো রেল কলোনীর সকল অভিভাবক ও সন্তানরাও হয়তো একদিন জরিনা বেগমের দেখানো পথ অনুসরণ করে কলোনীটিকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করবে, দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরবে তাদের কৃতিত্ব। আসুন আমরাও সকলে মিলে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে জরিনা বেগমের প্রজ্জ্বলনকৃত দ্বীপ শিখাটিকে মশালে পরিণত করি এবং শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিই কলোনীর দুইশত পরিবারের মাঝে।