বাউল নূর: গানেই যার বেঁচে থাকা…
অসীম কুমার সরকার, তানোর (রাজশাহী) থেকে
‘এখন আর আগের মতো কেউ গান শুনে না বারে। এখনকার গান শুধু লাফঝাপ।’ কথাগুলো বলেন নূর বাউল (৭৫)। পুরো নাম নুর মোহাম্মদ হলেও এলাকায় তিনি পরিচিত নূর বাউল বা নূর ফকির হিসেবে। সবাই তাঁকে চিনে নূর ফকির হিসেবে। ৭৫ বছর বয়সী এই বাউল শিল্পীর এখনও জীবন কাটে গান গেয়ে পথে পথে। জীবনের ক্লান্তিলগ্নে তবুও তিনি নব উদ্দ্যেমে গেয়ে যান গান ‘একবার মুখে খাজা বাবা বল, রে পাগলের দল’। খাজা বাবার পাগল যারা সুখের ভাগ্যি হয় না তারা।’ বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মানুষটির কন্ঠে বাউলের সেই মন ছুঁয়ে যাওয়া সুর। নূর ফকির আবেগ আপ্লুত কন্ঠে জানান, ‘বয়স হলে গান আমাকে ছাড়ে নারে বাবা। গানেই আমার বেঁচে থাকা।’ মাঘের তীব্র শীতে কাশতে কাশতে মুখে অসুস্থ্যতার ছাপ ফুটে উঠলেও তিনি কিছুক্ষণ পর আবার দীর্ঘ সুরে গেয়ে উঠেন দেহতত্ত্বের গান, ‘খাচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।’
গানের প্রতি নূর ফকিরের ভালোবাসা ছোটবেলা থেকেই। দাদা আর বাবার হাত ধরেই তিনি এ গানের পথে আসেন। তখন নূরের বয়স ছিলো পনের বছর। গ্রামে তো দুরের কথা শহরেও ছিলো না আধুনিক যন্ত্রের ছোঁয়া। শহরের অভিজাত শ্রেণির মানুষের বিনোদনের একমাত্র ব্যবস্থা ছিলো রেডিও। আর গ্রাম কিংবা শহরে মানুষ জারি, কিচ্ছা, আলকাপ, কবিগান গানের মাধ্যেমে তাদের বিনোদন খুঁজতো। গ্রামে গ্রামে বসতো এ সব গানের আসর। সেইসব আসরে দাদা-বাবা তালিম নিয়ে তার গানে হাতখড়ি। এভাবেই তিনি দিনে পর দিন গানকে বুকে ধারণ করে গেয়ে চলছেন। এখন তার একমাত্র সম্বল শুধুই গান। জীবনের ৬০টি বসন্ত পার হয়ে গেছে। আজও খঞ্জনি বাজিয়ে গান গেয়ে চলে তার জীবন।
নূর ফকিরের মুখ ভর্তি সাদা কালো দাড়ি। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। মাথায় গোল টুপি। দুই হাতের ছয় আঙ্গুলে বড় বড় রঙ্গিন পাথরের আংটি। গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। ঘাড়ে উপরে সাদা গামছা। হাতের মুঠে মধ্যে ঢোকানো পুরানো বাদ্য খঞ্জনি। গানই তার নেশা, গানই তার প্রাণ, গানই তার পেশা, গান নিয়েই তার সকল কাজ কর্ম, গানেই তার ধ্যান জ্ঞান, জীবন জীবিকার একমাত্র অবলম্বন।
নুর মোহাম্মদ জানান, গান শুনে যে যা বখশিস দেয় তা দিয়েই চলে তাঁর সংসার। গ্রামাঞ্চলে একসময় বাউল গানের আসর বসলেও বর্তমান প্রযুক্তির যুগে বাউল গানের আসর তেমন জমে উঠেনা। এক সময় তার যথেষ্ট কদর থাকলেও এখন আর নেই। এখন খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে তার সংসার। তিনি আরো জানান, সংসারে তিন ছেলে, তিন মেয়ে ও স্ত্রী মিলে সাত সদস্যের পরিবার। ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়ে সংসার পাতলা হয়েছে। বুড়ো হয়ে গেলেও তার হাত থেকে খঞ্জনি নামে না।
আগের মত কোন অনুষ্ঠান না পেলেও মাজার, গ্রামের কোন অনুষ্ঠান হলে তাঁর ডাক পড়ে। তবে আগের মত হয় না। মাসে, দুই মাসে দুই একটি জায়গায় থেকে ডাক পড়ে। তার গ্রামসহ বরেন্দ্র অঞ্চলে বিভিন্ন গ্রামে বাউল নুর বলে বেশ পরিচিতি রয়েছে। তবে তার নির্ধারিত কোন ফি নেন না। খুশি মনে যা দেয় তা নিয়েই খুশি থাকেন তিনি।