কালের বিবর্তনে বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যের ঢেঁকি
দেবদাস মজুমদার,বিশেষ প্রতিনিধি, উপকূলীয় অঞ্চল:
ও ধান বানরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া,
পিংকী নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া ।
ও ধান বানরে……
ধান বেচিয়া কিনমু শাড়ি পিন্দিয়া যাইমু বাপর বাড়ি,
স্বামী যাইয়া লইয়া আইব গারুর গাড়ি দিয়া।
ও ধান বানরে……………… ’’।
চিরায়ত বাংলার এই গান বাঙালির ঢেঁকির আবহ জানান দেয়। নতুন ধান বানা,সেই ঢেঁকিতে ছাটা নতুন চালে পিঠার গুড়ি। আবার ঢেঁকিতে চিড়া কোটা আবহমান বাংলার
ঐতিহ্যের অংশজুড়েই আছে ।
প্রবচনেও একদা শোনা যেত –
‘‘চিরা কুটি, বারা বানি,
হতিনে করইন কানাকানি।
জামাই আইলে ধরইন বেশ,
হড়ির জ্বালায় পরান শেষ।’
ঢেঁকি আমাদের শাশ্বত কৃষিনির্ভর গ্রামীণ জনপদে দরকারি ছিল একদা। তবে এখন যান্ত্রিক যুগের আধুনিকতায় মানুষ স্বল্প সময়ে ও শ্রমে দ্রুত আধুনিক ও নতুন নতুন প্রযুক্তি অতীতের ঐতিহ্যবাহী অনেক অনেক জিনিসপত্রের ব্যবহার বেড়েছে। আমাদের অতীত জীবনাচারের অনেক জিনিস পরিত্যাগ করছে। ফলে আমাদের অতীত ইতিহাস ঐতিহ্য সমাজ সংস্কৃতির অংশ ঢেঁকির ব্যবহার বলতে গেলে হারিয়েই গেছে।
আগেকার যুগে গ্রামের প্রত্যেক গৃহস্থ বাড়িতে ধান বানা ও চালের গুড়া কিংবা চিড়া কোটার জন্য ঢেঁকির ব্যবহার হতো। ঢেঁকিছাটা চাউলের কদর ছিল খুব। এ চাউলের ভাতের মজাই আলাদা। ঢেঁকিছাটা চাউলে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন বিদ্যমান তাই ঢেঁকিছাটা চালের চাহিদা আজও কমেনি।
ধান ভাঙা ঢেঁকি আমাদের গ্রাম বাংলার প্রাচীন গ্রামীণ ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশেও এর একটা বিশেষ গুরুত্ব ছিল। একসময় গ্রামগঞ্জসহ সর্বত্র ধান ভাঙ্গা, চাউল তৈরি, গুড়ি কোটা, চিড়া তৈরি, মশলাপাতি ভাঙ্গানোসহ বিভিন্ন কাজের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী ঢেকি। তখন এটা গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। কুটির শিল্প তথা পেশা হিসেবেও ঢেকিতে ধান বানা হত। গ্রামের সাধারণ গৃহবধূরাই ঢেঁকি সাধারণত চালনা করে।
জনশ্রুতি আছে, সত্তরের দশকে সর্বপ্রথম দেশে রাইসমিল বা মেশিন দিয়ে ধান থেকে চাল বের করার প্রচলন শুরু হয়। তখন থেকেই ঢেঁকির প্রয়োজনীয়তা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। একসময় সারাদেশে বছরজুড়ে তের পার্বণ পালিত হত। গ্রামগঞ্জে একটার পর একটা উৎসবের আমেজে ভরপুর থাকত। বাংলায় হেমন্ত উৎসব, পৌষ পার্বণ, বসস্ত উৎসব, বর্ষবরণ,বিয়ে উৎসব, পিঠা তৈরির উৎসব, হিন্দু সম্প্রদায়ের নানা পূজা, গায়ের মেলাসহ নানাবিধ অনুষ্ঠানের আয়োজন হত। এখনও এসব উৎসব হয় তবে ঠিক আগের মত সেই প্রাণ আর নেই।
গ্রামীণ নারীরা চালের গুড়ি দিয়ে নানা রকম পিঠা যেমন চিতল পিঠা, রুটি পিঠা, ঝুরি পিঠা, চুঙ্গা পিঠা, তালের পিঠা, পাটি সাপটা পিঠা, নুনগরা, নুনরডোবা, পব, সমুছা সহ তৈরি করতেন হরেক রকমের পিঠাপুলি। এসব তৈরি হত ঢেঁকিছাটা চালের গুড়ি দিয়ে।
কালের বিবর্তনে এসব পিঠা তৈরিতে ঢেঁকিছাটা চালে গুড়া তেমন আর ব্যবহার হয়না। ঢেঁকি হারিয়ে গিয়ে এর ব্যবহারও বিলুপ্ত। একদা গ্রামের বড় গৃহস্থ বাড়িতে ঢেকি থাকা ছিল অনেকটাই বনেদী সমৃদ্ধ গৃহস্থ পরিবারের পরিচয় বহন করত। এখন কালের পরিক্রমায় আমাদের ঐতিহ্যের ঢেঁকি প্রায়ই বিলুপ্ত। তাই গ্রাম বাংলার গৃহস্থ বাড়িতে এখন আর শোনা যায়না ঢেঁকির ছন্দময় শব্দ।