জীবনের জন্যই রক্ষা করি প্রাণ ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য
নেত্রকোনা থেকে মো. অহিদুর রহমান
ময়মনসিংহ গীতিকার চারণভূমি, মহুয়া মলুয়া, কাজলরেখা, দেওয়ানা মদিনা কাহিনী খ্যাত, হাওর বাওর, নদীনালা বিল জল জলাশয়ের, পাহাড় বনবাদার নলখাগরায় ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যের লীলাভূমি নেত্রকোনা। ভূ-প্রকৃতির কোথাও হাওরের সুবিশাল জলাভূমি, কোথাও পাহাড়, কোথাও সমতল কৃষিভূমি। এ জেলার মেঠোপথে ছড়ানো রয়েছে সরল মানুষের গল্প, ফসলে গল্প, আছে পাড়া গায়ের কিংবদ্বন্তী, কবিরাজের গল্প, শত শত পুকুরের গল্প, রয়েছে নদীর গল্প, বৃক্ষের গল্প ও হাওরের গল্প, পাহাড়ের গল্প, নানা প্রজাতির পাখি, প্রাণীর গল্প, মাছের গল্প, সাদা মাটির গল্প। এই সব গল্পের পরতে পরতে মিলে আমাদের নিত্যদিনের জীবনের গল্প। এখানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, বাঙালি, আদিবাসী সকলে মিলেমিশে বাস করে। প্রকৃতি সকল স্তরের মানুষকে এক সুতোয় বেঁধেছে। এ অঞ্চলে আছে পেশার বৈচিত্র্য, আছে ভাষার বৈচিত্র্য, জাতিতে জাতিতে বৈচিত্র্য, আছে জ্ঞানের ভিন্নতা, পরিবেশের অবস্থানের বৈচিত্র্য, প্রাণের বৈচিত্র্য, কাজের ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। এ অঞ্চলের বৈচিত্র্যতাই মানুষকে করেছে সাংস্কৃতিকমনা, অতিথিপরায়ন ও নিজের জীবনের ও জ্ঞানের প্রতি বিশ্বাস। দিন দিন কমে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যর সমারোহ। তৈরি হচ্ছে মানুষ ও প্রকৃতির ব্যবধান। ধীরে ধীরে মানুষ সরে যাচ্ছে প্রকৃতির ছত্রছায়া থেকে আর প্রকৃতি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মানুষের কাছ থেকে, যা একদিকে যেমন পরিবেশের জন্যে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনছে তেমনি মানুষের মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও মনুষত্বের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। মানুষে মানুষে সম্পর্ক কমছে, বাড়ছে সংঘাত।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র পলল গঠিত সমতল ভুমি ও হাওর অঞ্চলের বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের জীবন জীবিকা ও সম্পদ বিনিময় ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে টিকিয়ে রেখেছিল এঅঞ্চলের জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৫৮টি নদী, নালা, খাল, কংস, মগড়া, সুমেশ্বরী, উব্দাখালী, ধনু, ঘোড়াউৎড়া, বিষনাই, ধলাই, সাইডুলী, পাটেশ্বরী, গণেশ্বরীসহ প্রায় অর্ধশতাধিক নদী, সহ¯্রাধিক খালবিল, ৩৫ হাজার ৮৩৩ পুকুর ও ছোট বড় ৮৭টি হাওর। বিল, জলজলাশয়, মানুষের জীবন, পেশা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, আনন্দ বিনোদন, কৃষির উপর জলাভুমির অবদান বিছিন্ন করা যায় না। দিনকে দিন নেত্রকোনার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নদী, হাওর, বিল, জলাশয়, খাল, বিল। ফলে মানুষের জীবন ঝুকি পূর্ণ হয়ে পড়ে। মানুষ বাজারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কমতে থাকে প্রাকৃতিক সম্পদে অভিগমতা, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও বিনিময়, বাড়তে থাকে সম্পর্কহীনতা।
কৃষিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন, জীবিকা, শিক্ষা সংস্কৃতির মজবুত পাটাতন। ৫৮টি নদীর প্রবাহ পানি, কৃষিকে করেছে সমৃদ্ধি, নদীর, হাওরের পানির সেচের মাধ্যমে কৃষকের কৃষি চলতো, ঘরে তুলতো মাঠের ফসল। নদীর তরল মহাসড়কে চলতো পালতোলা নৌকা, প্রবাহমান এসব নদীর বিলুপ্ত, ভরাট, পানি শূন্যতা কৃষিকে করেছে বিপর্যস্ত। মগড়া, সাইডুলি, পাটকুড়া, বিষনাই নদীতে কৃষকেরা শত শত মেশিন বসিয়ে সেচের পানি সংগ্রহ করতো। কিন্তু এখন আর নদীতে পানি নেই। বোরো আবাদের জন্য মানুষেরা হন্যে হয়ে ভূগর্ভের পানি উত্তোলনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সাথে সাথে বাড়ছে উৎপাদন খরচও ।
নদী, খালবিল, হাওর, জলাভুমি বিলুুপ্তির ফলে কমছে প্রাকৃতিক মাছের বৈচিত্র্য, মানুষ সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে চাষকৃত মাছের উপর, প্রাকৃতিক মাছের উপর নির্ভরশীল জেলে পরিবারগুলো দিন দিন ঝুঁকির মাঝে পড়ে যাচ্ছে। পেশা হারিয়ে বেমানান হয়ে অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হয়েছে। গ্রামীণ জীবন-জীবিকা প্রকৃতিনির্ভর হওয়ায় জনগোষ্ঠীর স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের লক্ষ্যে লোকায়ত জ্ঞাননির্ভর প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা, লোকায়ত চর্চার মধ্য দিয়ে চলে প্রান্তিক মানুষের জীবন। জল, জাল, নদী, হাওর, বিল কিছুই আর জেলেদের নিয়ন্ত্রণে নেই। দিনদিন কমে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ; দখল হয়ে যাচ্ছে জলমহাল, শুকিয়ে যাচ্ছে নদী, নালা, খালবিল, মাছের অভয়াশ্রম, প্রজনন কেন্দ্র, বিলূপ্ত বিপন্ন মাছের প্রজাতি, হারিয়ে যাচ্ছে পেশা, জীবনে নেমে আসছে দারিদ্রতা।
আজকাল আর নেত্রকোনার পাহাড়ি নদী ও খর¯্র্েরাতা হাওরে রক্তিম রঙের পাখনা ও লেজ দোলানো সোনালি মহাশোল দেখা যায় না। শুধু মহাশোল নয় দেশীয় প্রজাতির মাছ রুই, কাতলা, বানহারি, বাগাইর, গুতুম কাজলি, কালা বাউশ, কৈ চিংড়ি, মাগুর, শিং, টেংরা, পাবদা, মলা, ঢেলা, চাপিলা, পাঙ্গাশ, শোল, চিতল, আইড়, মৃগেল, বাইম মাছসহ, কাছিম, কাঁকড়া, সাপসহ নানা প্রজাতির জলপ্রাণীর ভান্ডার ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। নদী ও সংস্কৃতি একসাথে গাথা। নদীকে কেন্দ্র করে গান, কবিতা, গল্প, অনুষ্ঠান, নৌকা বাইচ, নৌকা ভ্রমণ, কত কিছুই না রচিত হতো, আয়োজন হতো। নদী হারিয়ে যাওয়া মানে সংস্কৃতি হারিয়ে যায়, গান হারিয়ে যায়, বিনোদন হারিয়ে যায়, ভাষা হারিয়ে যায়, প্রাণবৈচিত্র্য হারিয়ে যায়, মাছ হারিয়ে যায়। প্রাণবৈচিত্র্য ও জলাভূমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দিনদিন জলাভূমি কমে যাওয়ার ফলে মাছ, জলজ খাবার, শামুক, ঝিনুক, কচ্ছপ, ব্যাঙ, অণুজীবসহ এলাকায় প্রাণবৈচিত্র্য দিন দিন কমে যাচ্ছে। আর মানুষ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে বাজারের উপর।
পর্যটন এলাকা নেত্রকোনা। গারো পাহাড়, সাদা মাটির পাহাড়, সীমান্তের ছোট ছোট টিলা, দিন দিন ক্ষয়ে যাচ্ছে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের লীলা ভূমি নেত্রকোনা, জারি, সারি, কবিগান, বাউলগান, ঘাটুগান, মহুয়া, মলুয়া, কাজলরেখার কাহিনী, ময়মনসিংহ গীতিকার চারণভূমি নেত্রকোনা। আজ সকল সংস্কৃতিই হারাতে বসেছে।
আমাদের প্রয়োজনেই আমাদের নেত্রকোনার প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রাণ, প্রাণসম্পদ, নদীনালা, খালবিল হাওর রক্ষা করা প্রযোজন। প্রকৃতি থেকেই মানুষ শিখেছে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক অতি প্রাচীন ও দুর্গম। সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষের স্পর্শে প্রকৃতি, প্রকৃতির সান্নিধ্যে মানুষ সেজেছে নব নব রূপে। টিকে থাকার সংগ্রাম উভয়কেই করেছে বৈচিত্র্যময়। কারণ বৈচিত্র্যতাই সমৃদ্ধি, বৈচিত্র্যতাই উন্নয়ন, বৈচিত্র্যতাই সুন্দর।
মানুষের টিকে থাকার জন্যেই প্রয়োজন প্রাণী উদ্ভিদ জল, বায়,ু মাটির সহ-অবস্থান। তাই টিকে থাকার জন্যেই মানুষের উচিত তাদের প্রকৃতিকে সচল রাখা। মূলত প্রত্যেকটি সমাজব্যবস্থায় প্রতিবেশ, সমাজ সংস্কৃতি ও অর্থনীতি সামাজিক বৈচিত্র্যের উপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে। সামাজিক এ বৈচিত্র্যে জন্ম হয়েছে ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য থেকে। ভূ প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের জন্ম হয়েছে উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্র্য থেকে। তাই প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ছাড়া মানুষের টিকে থাকা কঠিন। এ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে হলে নেত্রকোনার মানুষকে এগিয়ে আসতে। মাতৃস্বরূপা প্রকৃতি আমাদের অত্যাচারে আজ তিলতিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির বৈচিত্র্যহীনতাই আমাদের বৈচিত্র্যহীনতার জন্যেই দায়ি। তাই সবার আগে প্রাধান্য দিতে তার বৈচিত্র্যঘেরা প্রকৃতিকে। এর জন্যে সকলের সম্মেলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। তাই জীবনের বৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনতে হলে প্রকৃতি মায়ের বৈচিত্র্য রক্ষায় নেত্রকোনার সকল মানব সন্তানকে এখনই উদ্যেগী হতে হবে। আমাদের নদী, নালা, খাল, বিল, হাওর, জলাশয়, পাহাড়, বন, প্রাণী, গাছ, লতা, পাতা, সাংস্কৃতি বৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে হবে। এতেই নিশ্চিত হবে আমাদের জীবন ও জীবিকা। কৃষক জেলে, কুমার, কামার, আদিবাসী, হাওর পাড়ের মানুষ কবিরাজ মিলে রক্ষা করতে হবে আমাদের প্রকৃতি, প্রাণবৈচিত্র্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, রক্ষা করতে হবে আমাদের সম্পর্ক, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, জাগিয়ে তুলতে হবে পরস্পরের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ।
এখনো নেত্রকোনা অঞ্চলের মানুষ বৈচিত্র্যতাকে রক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। কৃষক সায়েদ আহমেদ খান বাচ্চু, আ: ওয়াদুদ খান, আ: আলীম শত শত জাতের ধান বৈচিত্র্যকে রক্ষা করছেন, জেলে যোগেশ চন্দ্র দাস মাছের অভয়াশ্রম করে ও নদী জলাশয় রক্ষা করে স্থানীয় জাতের মাছ রক্ষা করছেন, কবিরাজ আ: হামিদ ও নুরুল ইসলাম শত শত জাতের ঔষধি গাছ রক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, আ. রশিদ ফকির পাখি রক্ষার জন্য চেষ্টা করছেন। কৃষাণী সখিনা সবজি বৈচিত্র্যতাকে রক্ষায় নারীদেরকে উৎসাহিত করছেন। কৃষক আ: রহমান শিক্ষা সংস্কৃতি ও সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। কৃষক গোলাম মোস্তফা প্রাণের বৈচিত্র্যতাকে রক্ষার জন্য মাটিকে ভালো রাখার কাজ করে যাচ্ছেন। নেত্রকোনা অঞ্চলের যুবকরা প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষার জন্য ২৫ সংগঠনের মাধ্যমে কাজ করছেন। এভাবে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রকৃতি, পরিবেশকে রক্ষা করবো, পরস্পরের প্রতি আন্তঃনির্ভরশীলতার সংস্কৃতি আবার ফিরিয়ে আনবো; নিশ্চিত করবো পৃথিবী সকল প্রাণের সহাবস্থান!