আমরা যেন কারও বোঝা না হই
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের সাতক্ষীরা জেলার সর্বাধিক দূর্যোগ ঝূঁকিপূর্ণ জনপদ শ্যামনগর উপজেলা। ২০০৯ সালের সংঘটিত প্রাকৃতিক দূর্যোগ আইলা এই উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের ১১ ইউনিয়ন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এ ক্ষতিগ্রস্তের মধ্যে ১১নং পদ্মপুকুর ইউনিয়ন ছিল অন্যতম। ইউনিয়নের চারিধার খোলপেটুয়া নদী। চারিদিকে নদী থাকায় প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দূর্যোগ ঝুকিপূর্ণ ইউনিয়নটি। প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হয় এখানকার মানুষদের।
এ ইউনিয়নের পাখিমারা গ্রামটি আইলা বিধস্ত একটি গ্রাম। বিগত সময়ে পাখিমারা গ্রামে বারসিক কর্মকর্তারা মাঠ পর্যবেক্ষণে গেলে এলাকার বিভিন্ন ধরনের সমস্যার কথা জানতে পারেন। তাদের এখানে সবচেষে বেশি যে সমস্যা তা হলো নদী ভাঙন। স্থানীয়দের মতে, নদীভাঙন ছাড়া আর কোন সমস্যা তাদের দমাতে পারেনা। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ গ্রহণ করলেও এ থেকে উত্তরণের অন্য কোন উপায় পাওয়া যায়নি। একদিকে নদী ভাঙন অন্যদিকে নদীর ও চিংড়ি ঘেরের লবণ পানির সাথে সব সময় নিজেদের জ্ঞান, বৃদ্ধি, ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। লবণাক্ততা এ পরিবেশে কখন কোন সময় কি ফসল লাগানো যায় তার অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এখানকার নারীরা।
বিভিন্ন সময় সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে এ গ্রামের একদল আগ্রহী ও উদ্যোগী নারীরা। তাদের এ কাজকে গতিশীল ও শক্তিশালী করতে তারা বারসিক কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করেন। ২০১৬ সালে দিকে প্রথম বারসিক কর্মকর্তারা উপজেলা কৃষি অফিসের সাথে তাদের যোগাযোগ করিয়ে দেন। যোগাযোগের একপর্যায় ২০১৬ সালে মে মাসের দিকে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ডি এই-ডি ডানিডা উদ্ভিদ সংরক্ষণ কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ (এস পি পি এস) প্রকল্প কর্তৃক পরিচালিত বোরো মৌসুমের ফসলের উপর কৃষক মাঠ স্কুলের মাধ্যমে আইএফএম প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন ২৫ জন নারী ও ২৫ জন পুরুষসহ মোট ৫০ জন কৃষক-কৃষাণী। আর উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে এ প্রশিক্ষণ প্রদান করেন উপজেলা জনসংগঠন সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ সিরাজুল ইসলাম ও ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক মো. সিদ্দিকুল ইসলাম। প্রশিক্ষণের পর তারা একত্রিত হয়ে একটি সংগঠন তৈরি করার কথা জানান।
নারীদের মধ্যে আগ্রহী মনোভাব দেখে প্রশিক্ষকদ্বয় পুনরায় আবার বারসিকের সহায়তা নিতে বলেন। এরপর ২০১৭ জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি মাসে কৃষাণী রাবেয়া বেগমের নেতৃত্বে ১৫ জন নারী একত্রিত হন এবং সংগঠন তৈরিতে বারসিকের পরামর্শ গ্রহণ করেন। একপর্যায় নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে আগ্রহী, নারীদের আয়বর্ধনমূলক কাজে নিজেদের যুক্ততা বাড়ানোর জন্য ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে ১৫ জন নারীর অংশগ্রহণে সমন্বিতভাবে একটি সংগঠন তৈরির প্রস্তাব করা হয়। সংগঠনের নাম রাখা হয় ‘পাখিমারা পরিবেশবান্ধব আইএফএম কৃষি নারী সংগঠন’।
সংগঠন তৈরির সাথে সাথে এলাকার জন্য কি কি কাজ করা যায় তা নির্ধারণ করেন সদস্যরা এবং পরিকল্পনায় তা যুক্ত করেন। সংগঠন তৈরির পর বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম তারা চালিয়ে যাচ্ছেন। যেমন দিবস পালন, অচাষকৃত উদ্ভিদ বৈচিত্র্য সংরক্ষণে আলোচনা, পাড়া মেলা, স্কুল পর্যায়ে কুইজ প্রতিযোগিতা, সঞ্চয় সম্প্রসারণ, নিজেদের ব্যাংক হিসাব খোলা, জৈব বালাইনাশক তৈরি ও ব্যবহারে প্রশিক্ষণ, চুলা ও হাজোল তৈরিতে প্রশিক্ষণ, নদীর চর বনায়ন, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সেবা আদায়ে যোগাযোগ, স্থানীয় মুরগি জাত সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে মুরগি গবেষণা, বসতভিটায় সবজি চাষ, অভিজ্ঞতা বিনিময় সফর, প্রাণী সম্পদের ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্প আয়োজনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজন ও বাস্তবায়ন করে চলেছে।
বর্তমানে এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ১৫ জন। এই প্রসঙ্গে কৃষাণী রুপিয়া বেগম বলেন, “আমরা এ সংগঠন করেছি কিছু শেখা জানা এবং অন্যদেরকে জানানো। আমরা যে এলাকায় বসবাস করি সেখানকার মানুষের উন্নয়নের জন্য।” কৃষানী সাহানারা বেগম বলেন, “আমি আগে কারো সাথে কথা তেমন কথা বলতাম না আমাদের পাশে ইউনিয়ন পরিষদ আছে সেখানেও কোন সময় যাইনি। কিন্তু সংগঠন তৈরির পর বিভিন্ন আলোচনায় কথা বলতে পারছি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্টানের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি। বিশেষ করে অল্পনা রানী কৃষি বাড়ি এবং তার কার্যক্রম দেখে আমরা বেশি আগ্রহী হয়েছি।” সভানেত্রী রাবেয়া সুলতানা বলেন, “আমরা যাতে নারীরা কারো উপর কোন বোঝা না হই নিজেদের অধিকার আদায় করতে পারি। শ্যামনগরে অনেক নারী সংগঠন দেখেছি তারা যেমন বিভিন্ন জায়গায় নেতৃত্ব দিচ্ছে আমরা ও যাতে নেতৃত্ব দিতে পারি সেজন্য এ সংগঠন তৈরি করেছি। এছাড়াও বারসিকের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে বারসিকের কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা লাভ করেছি যাতে আমাদের সংগঠিত হতে ভূমিকা রেখেছে।”
উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ বেষ্টিত পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাখিমারা গ্রামের একদল আগ্রহী ও উদ্যোগী নারীরা এলাকার সার্বিক উন্নযনের ভূমিকা রাখার জন্য পরিকল্পিতভাবে এ সংগঠন গড়ে তুলেছেন। সফল ও স্বার্থক হোক পাখিমারা পরিবেশবান্ধব আইএফএম কৃষি নারী সংগঠনের পথচলা।