১১০ বছরেও সব কাজ করেন ‘কারিগর’!
অসীম কুমার সরকার, তানোর (রাজশাহী)
বয়স ১১০। স্বাচ্ছন্দেই চলাফেরা করেন ‘কারিগর’। তার পুরো নাম নিমাই চন্দ্র কারিগর। নিজের রোজগারে নিজেই বাজার করে চলেন। নিজেই সব রান্না করে খান। স্ত্রী মারা গেছেন ৩৫ বছর আগে। তখন থেকে তিনি একাই চালিয়ে যাচ্ছেন তার সংসার। এখনও পায়ে হেঁটে বাজারে তাঁর হাতের তৈরি পাঁপড় বিক্রি করেন। কথা বলেন টসটসে। চেখে দেখেন পরিস্কার। আর অবসরে বেরিয়ে পড়েন গুরু ঠাকুরের সঙ্গে শিষ্যের বাড়ি। যদিও তার গুরুঠাকুর হরিকুমার অধিকারী মারা গেছেন ৮০ বছর আগে। সেই গুরুর পুত্র অশ্বিনীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন তিনি। পর্যায়ক্রমে অশ্বিনীর ভাই সুধীর, তার ভাতিজা সন্তোষের শিষ্যত্ব করেছেন। বর্তমানে সন্তোষ পুত্র পঞ্চম গুরুঠাকুর সনজিত অধিকারীর শিষ্যত্ব সাঙ্গ দিচ্ছেন নিমাই কারিগর। তিন মেয়ে ভারতে থাকেন। তিনি বাস করেন তানোর পৌর এলাকার গোল্লাপাড়া গ্রামে। অন্যের জায়গায় ছোট্ট একটি চালাঘর বানিয়ে থাকেন।
গত শুক্রবার সকালে এই প্রতিবেদক তার জীর্ণ বাড়িতে যায়। তখন তিনি ভাত রান্না করে বেগুন ভর্তা করছেন। পাশে আলু ভর্তা ও ডাল ভর্তার বাটি। এ সময় তিনি জানান, নিজেই সব রান্না করে খান। অন্যের হাতের রান্না খেতে তার ভালো লাগে না। তাই নিজের মনের মতো রান্না করে খান। তিনি খেতে ভালোবাসেন শাকসবজি, মাছ, ডাল ও ডিম। বড় একবাটি ডাল ও একসাথে ৪ থেকে ৫টি হাঁসের ডিম খান। শাকসবজি খান ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম। সব তরকারিতে কাঁচা মরিচ খান। আর শাক রান্না করেন রসুন দিয়ে। কিন্তু ডিম রান্না করেন পিঁয়াজ দিয়ে। তার আফসোস এখন সব কিছুতে ভেজাল। তাই তিনি সরিষার তেল দিয়ে রান্না করেন। আগে বাদামের তেল তার খুব প্রিয় ছিল এখন না পেয়ে সরিষার তেল গায়ে-হাতে দেন। সার-বিষ দিয়ে এখন সব কিছুতেই ভেজাল আর পুষ্টিগুণ নেই। আগে একবিঘে জমিতে একবার আবাদ করে ১০ মণ ধান পাওয়া যেত। খেতেও সুস্বাদু ছিলো। এখন তিন ফসলী জমিতে অনেক ধান পাওয়া গেলেও সেই পুরনো দিনের মতো স্বাদ নেই বলে তিনি জানান।
তিনি জানান, আমাশয়ে তিনি বরের (বরই) টক খান। তাতে আমাশয় সেরে যায়। সর্দি-জ¦র হলে সরিষার তেল গরম করে বুকে-পিঠে দেন এতে উপশম হয়। শরীর কোথাও ছোট-খাটো কেটে গেল লবণ দিয়ে বেঁধে দেন। আস্তে আস্তে সেই ক্ষতস্থান পুড়ে ভালো হয়ে যায়। খুব খারাপ অবস্থা না হলে তিনি কখনও চিকিৎসকের কাছে যান না। তবে গুরুঠাকুরের সাথে শিষ্যের বাড়িতে গেলে শুধু ফলমূল ও দুধ খান । ৪৭ দেশ ভাগের সময় তার বয়স ছিল ৩৮ বছর। সেই সময় স্বদেশী আন্দোলনে জমিদারপুত্রদের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। দেশভাগের পর রাজশাহীর পবা উপজেলার দারুশা ডাঙ্গায় তিনি পালিয়ে ভারতে যান। সেই সময় মহিষের লেজধরে রাজশাহীর পদ্মানদী পার হয়েছেন। তখন ভারতের চরে গিয়ে দেড় টাকা সেরে হাফ কেজি মিষ্টি কিনে খান। আবার ফিরে আসেন বাংলাদেশে সিরাজগঞ্জ সদরের ধানবাঁন্দি এলাকায়। পরে পার্বতীপুর ঔষুধের ল্যাবটারিতে ৫ টাকা বেতনে চাকুরি করেন।
কারিগর বলেন, ‘৫৪ সালের দুর্ভিক্ষে খুব কষ্ট পেয়েছি জীবনে। সেই দুর্ভিক্ষের সময় খেসারি ডালের ছাতু ও মিষ্টি আলু খেয়ে কাটিয়েছি। এমন কষ্টের দিনে মানুষ একটু খাওয়ার জন্য বাড়ি-ঘর পর্যন্ত মানুষকে দিয়ে দিতো। এখন সেইসব কথা ভাবলে খুব কষ্ট হয়।’
বর্তমানে বেঁচে নেই তার সমবয়সী কোন বন্ধু-বান্ধব। ১০ বছরের ছোট শতবছর বয়সী লালপুরের হাজ্বী এরশাদ মেম্বারও মারা গেলেন। তানোর উপজেলায় তার বয়সী কেউ জীবিত নেই বলে তিনি জানান। গোল্লাপাড়া গ্রামের গৌতম কুমার দাস কারিগর সম্পর্কে বলেন, ‘দাদুর অসুখ-বিসুখ তেমনভাবে দেখা যায় না। তবে শরীরের কোন স্থান কেটে গেলে লবণ দিয়ে কাপড় পেঁচিয়ে বেঁধে দেন। কিছুদিন পর ওইস্থান পুড়ে ভালো হয়ে যায়। পাঁচফূরণ ও তেজপাতা পুড়িয়ে এতো সুন্দর ডাল রান্না করেন যে চারিদিকে ঘ্রাণ ছড়িয়ে যায়। এখনও নিজেই রান্না করে খান। খাওয়া-দাওয়ায় বেশ পটু কারিগর দাদু।
উপজেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি সুনীল দাস, গোল্লাপাড়া গ্রামপ্রধান বিশ্ব দাসসহ একাধিক ব্যক্তিরা বলেন, ‘কারিগরকে তারা জন্মের পর থেকে একইভাবে দেখছি। আগের মতোই কারিগর এখনও পূজা, হরিবাসর কিংবা যে কোন অনুষ্ঠানে পাঁপড় বিক্রি করেন। দিন যতই যাচ্ছে আমাদের বয়স যেন ততই বাড়ছে। কিন্তু কারিগর, সেই আগের মতোই দেখছি। তার যেন বয়স বাড়ে না!