উপকূলীয় এলাকার সাহসী মানুষের জীবন আখ্যান
সিলভানুস লামিন::
অহর্নিশ সহচর সমস্যা, তারপরও নতুন স্বপ্ন বোনা
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলটি জলবায়ু দুর্যোগে সবচে’ নাজুক একটি এলাকা। উপকূলীয় এই দুর্যোগপ্রবণ এলাকার মধ্যে সাতক্ষীরা জেলা অন্যতম। লবণ পানি, চিংড়ি চাষ, কৃষিজমি অকৃষিখাতে ব্যবহার, উন্নয়ন উদ্যোগের ব্যর্থতা নানান সমস্যাকে সঙ্গী করে এই জেলার মানুষগুলোকে বেঁচে থাকতে হয়। বেঁচে থাকার তাগিদে নিত্যনতুন স্বপ্ন বোনা, দুর্যোগে এসব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হওয়া, আবার নতুন স্বপ্ন বোনা, অর্থনৈতিক আয়ের পথ সঙ্কুচিত হওয়া, লবণাক্ততায় কৃষি-ফসল উৎপাদনে সমস্যা, সুপেয় পানি সঙ্কট, জীবিকা নির্বাহের তাগিদে সুন্দরবনে সম্পদ সংগ্রহ, সম্পদ সংগ্রহে জলদুস্য ও বাঘের আক্রমণের শিকার হওয়া, বাঘ বিধবাদের সামাজিক স্বীকৃতির অভাব-এই সমস্যাগুলো অহর্নিশ সন্মুখীন হতে হচ্ছে এসব মানুষদের! সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ, দাঁতিনাখালী, হায়বাতপুর, চুনকুড়ি, বুড়িগোয়ালিনি, গাবুরা ইউনিয়নের ৯নং সোরা গ্রামের মানুষের ভাষ্যমতে, চিংড়ি চাষের পূর্বে এই এলাকায় এত সমস্যার পাহাড় ছিলো না! কৃষিজমিতে ধানসহ অন্যান্য ফসল আবাদ হতো বলে ‘কাজের’ কোন সমস্যা হতো না! চিংড়ি ঘেরে কম শ্রমের প্রয়োজন হয় বিধায় চিংড়ি চাষ প্রবর্তনের পর থেকেই এলাকায় বেকারত্বের হার বেড়েছে, বেঁচে থাকার জন্য সুন্দরবনে সম্পদ সংগ্রহের কারণে সুন্দরবনের ওপর চাপ বাড়ছে। সুন্দরবনের বাঘ বনে খাবার না পেয়ে মানুষের ওপর আক্রমণ করেছে, এমনকি খাদ্যের জন্য তারা লোকালয়েও চলে আসা শুরু করেছে!
সাইনবোর্ড সর্বস্ব উন্নয়ন!
মুন্সিগঞ্জ থেকে দাঁতিনাখালী গ্রামের দূরত্ব বেশি নয়। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবস্থা দু’টিই খুবই নাজুক বলে এই গ্রামে পৌছুতে বেশ সময় লেগেছে। গ্রামের চারপাশ অনেক জমি। তবে কৃষি নয় সেখানে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। ইদানীং কাঁকড়া চাষও বেড়েছে। কৃষি শস্য-ফসলের সোনালি-সবুজ আবরণে যে জমিগুলো ঢাকা পড়ার কথা সেখানে চিংড়ি ও কাঁকড়া প্রদর্শনী প্লটের নানান ‘সাইনবোর্ড’-এ ভরে গেছে। এই ‘সাইনবোর্ডগুলো’তে বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন-প্রতিষ্ঠানের নামও রয়েছে যারা এই গ্রামের মানুষের ‘উন্নয়ন’র জন্য কাজ করে যাচ্ছে! তবে মানুষের ভাগ্যের আর উন্নয়নই হচ্ছে না! দাঁতিনাখালী গ্রামের বনজীবীরা তাদের বসতভিটা উচু করে রাখেন। কারণ জোয়ারের কারণে প্রতিদিন তাদের বসতভিটা প্লাবিত হতে পারে! গ্রামে যেখানে কিছুটা হলেও সবুজ দেখা গেছে সেটা হলো মানুষের বসতভিটার সামান্য জায়গা, যেখানে তারা বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন শাকসবজি আবাদ করেন। কৃষি শস্য-ফসল উৎপাদনের সুযোগ না থাকায় গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই সুন্দরবনে সম্পদ সংগ্রহের সাথে জড়িত। বনের সম্পদের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে বলে এদেরকে ‘বনজীবী’ বলা হয়। কেউ কেউ মাওয়ালী, বাওয়ালী, চুনারী নামেও পরিচিত। সম্পদ সংগ্রহের জন্য সুন্দরবনে প্রবেশ করলে তারা নিশ্চিত থাকেন না যে, জীবিত না মৃত অবস্থায় ফিরে আসতে পারবেন! তারপরও জীবন চাকাকে সচল করার জন্য ঝুঁকি নিয়ে তারা সুন্দরবনে প্রবেশ করেন। এদের অনেকে লাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে, কেউ মারাত্মক আহত হয়ে, কেউবা আবার নিখোঁজ রয়েছেন এখনও! বনজীবীরা এখনও সুন্দরবনে প্রবেশ করেন সম্পদ সংগ্রহের জন্য! তারা জানেন না কবে অবসান হবে তাদের এই ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান! খাদ্যের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য যেখানে সমস্যা প্রকট সেখানে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও যে অপ্রতুল তা বলাই বাহুল্য! গ্রামে খাবার পানির সঙ্কট খুবই প্রকট। অনেকদুর থেকে সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে হয়। নারীদেরকে সময় ও শ্রম দু’টিই বেশি ব্যয় করতে হয় সুপেয় পানি সংগ্রহে, ইদানীং যদিওবা পুরুষেরা এ কাজে তাদের সাহায্য করে। স্বাস্থ্যসেবার চিত্র আরও ভয়াবহ। অনেকে বলেছেন, স্বাস্থ্যসেবা পর্যাপ্ত না হওয়ায় বাঘ আক্রমণের শিকার হওয়া ব্যক্তি চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করেন! তবে আশার কথা হলো এত সমস্যার মধ্যে থেকে এই মানুষগুলো মনোবল হারাননি! জীবন-জীবিকার উন্নয়নের জন্য তারা নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়েছে। বারসিক’র সহযোগিতায় তারা কেওড়া ফল থেকে আচার, চকলেট, জেল, মৌচাক থেকে মোম, সাবান তৈরি করছেন, মধুর বাজারজাতকরণে জন্য বারসিকের সহযোগিতা পাচ্ছেন, বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ পেয়ে তারা এই কাজগুলো করছেন, অন্যকেও শিখাচ্ছেন! সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে তাদের যোগাযোগ বৃদ্ধি হচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের সেবা-সুযোগ পাচ্ছে। তাদের ভাষ্যমতে, গ্রামে নারী নির্যাতন, বাল্য বিবাহের হার অনেক কমে গেছে! সবাই সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন জীবন-জীবিকার সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য। এজন্য তারা সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সহযোগিতা চাচ্ছেন!
কাজ চাই, রিলিফ নয়
সিডর-আইলায় উপকূলীয় এলাকায় অনেক মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন! নিঃস্ব হয়েছেন! আমরা এ মানুষগুলোকে ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’ বলি! এদের সবচে’ অসহায় মনে করি, এদের প্রতি সহমর্মীতা দেখাই আর কত কি! কিন্তু তারা মনোবল হারাননি বা হতাশ হননি! তারা মনে করেন মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার, খাদ্য খাবার, কথা বলার, বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করার অধিকার রয়েছে তাদের। নিঃস্ব, দরিদ্র, ভূমিহীন এসব মানুষের পুর্নবাসনের জন্য সরকার ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে শ্যামনগর বুড়িগোয়ালিনি ইউনিয়নে একটি আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। স্থানীয়ভাবে এটিকে ব্যারাক বলা হয়। ৮০টি দরিদ্র ও ভূমিহীন পরিবার এ ব্যারাকে বসবাস করে এখন। ঘর দেওয়ার পর পরই সরকার মনে করে তার দায়িত্ব শেষ! কিন্তু এসব মানুষগুলো কী খেয়ে বাঁচবে? প্রতিটি পরিবারকে অতিসামান্য বসতভিটার জমি বরাদ্দ করা হলেও এই জমিগুলো লবণাক্ততায় আক্রান্ত! এখানে কিছু হবে না। এসব জমি কীভাবে আবাদযোগ্য করা হবে সেই ব্যাপারে তাদের কোন নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি! তবে বারসিক’র সহযোগিতায় এসব মানুষ তাদের সামান্য বসতভিটার জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন। কয়েকবছর আগেও যেটাকে আমি মরুভূমি হিসেবে দেখে আসছি সেখানে এখন সবুজের সমারোহ! এসব মানুষ বারসিক, হায়বাতপুর কৃষক সংগঠনের ফরিদা পারভীন, সিরাজুল ইসলামদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তাদেরকে কৃষি উপকরণ, প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। জমিগুলোকে আবাদযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতার জন্য! সামান্য বসতভিটায় সবজি উৎপাদন করতে পারায় পরিবারের সবজির চাহিদা মেটাতে পারছেন। যে টাকা সবজি ক্রয়ে ব্যয় হতো সেটা অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারছেন। কিন্তু ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য তাদের ‘কাজ’ দরকার বলে তারা জানিয়েছেন। কাজের অভাবে অনেক সময় না খেয়েও থাকতে হয়েছে তাদের তা অপকটে স্বীকার করেছেন। তাদের ভাষ্যমতে, “শুধু ঘর দিয়ে আমরা কী করবো? আমাদের কাজ দ্যান? আমাদেরর তো ক্ষুধা, পিপাসা আছে! আমরা রিলিফ চাই না, চাই কাজ”। এসব মানুষগুলো বেশির ভাগই দিনমজুর। কিন্তু দিনমজুরির জন্য তো কাজ থাকা লাগবে। চিংড়ি ঘেরে কয়েকজন মানুষ কাজ করতে পারে। অন্যরা তাই কাজের সন্ধানে নিজ পরিবার ছেড়ে মাসের পর মাস বিভিন্ন এলাকায় থাকতে হয়েছে। মুন্ডা আদিবাসী বিনোদিনির স্বামী বর্তমানে কুমিল্লায় একটি ইটভাটাতে কাজ করছেন। দীর্ঘ ছয়মাস ধরে বাড়ি আসেননি তিনি!
মনোবল ও মানসিক শক্তিই বাঁচিয়েছে বাঘ বিধবাদের
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়ন একটি পরিচিত নাম। আইলা-সিডরে সবচে’ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই ইউনিয়নটি। সিডর-আইলার ধ্বংসস্তুপ এখনও এই ইউনিয়নে দেখা যায়। সোরা ৯নং গ্রামটি এখনও লবণ পানিতে প্লাবিত। জোয়ার সময়ে এই পানি অনেকের উচু ভিটার শেষ সীমা পর্যন্ত চলে আসে! গ্রামবাসী বেশির ভাগই সুন্দরবনে সম্পদ সংগ্রহের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। সুন্দরবনে সম্পদ সংগ্রহে করতে গিয়ে এই গ্রামের অনেক পুরুষ বাঘের আক্রমণের শিকার হয়ে মারা গেছেন। ২০১১ সালের বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী শুধুমাত্র এই গ্রামেই ৫২ জন বাঘ বিধবা রয়েছে, পুরো ইউনিয়নে এর সংখ্যা ৪৭৬ জন জানালেন লিডার্সের নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার ম-ল! সম্পদ সংগ্রহের জন্য স্বামী বনে গেলে নারী ঘরে বসে থাকে। নানান কুসংস্কার তাদেরকে এসময় পালন করতে হয়। কেউ সুন্দরবনে গেলে বাঘের আক্রমণের শিকার হয়ে মারা গেলে দোষারূপ করা হয় নারীকে। তাকে অপয়া হিসেবে অভিহিত করা হয়, স্বামীর অ-বর্তমানে ওই নারী নিশ্চয় দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছে! এজন্য তার স্বামীকে বাঘে ধরেছে! নারীকে নানাভাবে দোষারূপ করা হয় বলে সমাজে তাকে ভালো চোখে দেখা হয় না, তাকে সমাজ থেকে নির্বাসিতই করা হয়। তার সাথে কেউ কথা বলে না, যোগাযোগ করে না ইত্যাদি। এছাড়া নারীদের কোন সন্তান থাকলে সেই সন্তানের সাথেও সমাজের মানুষ ভালো ব্যবহার করে না, মেয়ের বিয়ে দিতে বেশি যৌতুক চাওয়া হয় ইত্যাদি। স্বাভাবিক বিধবাদের (যাদের স্বামী রোগে অথবা অন্য কোন কারণে মারা গেছে) জন্য ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বিধবা ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হলেও বাঘ বিধবাদের এসব সুবিধা দেওয়া হয় না! সরবানুরা জানান বাঘের আক্রমণের শিকার হয়ে স্বামী মারা যাওয়ায় এমনিতেই অর্থনৈতিকসহ নানান সমস্যায় পড়তে হয় তার ওপর সামাজিকভাবে তাদেরকে অবহেলা করায় তারা চরম মানসিক কষ্টে আছেন! কিন্তু এসব নারীরা বসে নেই। তারা তাদের জীবন-জীবিকার জন্য, সন্তানদের মানুষ করার জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কেউ বসতভিটায় সবজি করেন, দিনমজুরি করেন, মাছ ধরেন এবং প্রশিক্ষণ পেয়ে নানান আয়মূলক কাজে নিজেদের নিয়োজিত করে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনয়ন করছেন অন্যদিকে স্বজন হারানো ও সামাজিক অবহেলার মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক যন্ত্রণা ভূলে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন এই সাহসী মানুষগুলো! আসুন এসব সাহসী মানুষকে শ্রদ্ধা জানাই, তাদের পাশে দাঁড়াই!