একজন কোহিনূরের পথচলা
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিধান মধু
“অভাব অনটনের মধ্যে দিন কাটিয়েছি ভেবেছিলাম বিয়ে হওয়ার পর সুন্দর একটি সংসার হবে যেখানে থাকবে না কোন অভাব অনটন কিন্তু এখানে এসেও আমার কপালে এটা থাকবে ভাবতে পারিনি”। কথাগুলো বলছিলো শ্যামনগর উপজেলার ভুরুলিয়া ইউনিয়নের সোনামুগারী গ্রামের কোহিনূর বেগম। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। ছোট বেলা থেকে তিনি ছিলেন অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির। বাবা গরিব বিধায় লেখাপড়ার গন্ডি বেশি পার হতে পারেননি, অল্প বয়সেই সতীনের ঘরে বিয়ে হয় কোহিনূর বেগমের। বিবাহিত জীবন মোটেও সুখময় ছিল না তার। নতুন করে সঙ্গী হলো দুঃখ কষ্টের। স্বামী সন্তান নিয়ে সংসারে অভাব অনটন লেগেই ছিল। সংসারে সকল বাধা অতিক্রম করে থেমে থাকেনি কোহিনূরের পথচলা। শুরু হলো চিন্তা ভাবনা। কি করে সংসারে আয় উন্নতি করা যায়। বিদ্যা বেশি না থাকলে ও বুদ্ধির বিকাশ ঘটিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে চলছিলো কোহিনূর বেগম। প্রথমদিকে বাড়ি থেকে কিছুটা চাপ থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের প্রশিক্ষণের জন্য শ্যামনগর উপজেলায় যেতে হতো। বারসিকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তিনি সবজি চাষ বিষয়ক পরামর্শ, মৎস্যচাষ বিষয়ক প্রশিক্ষণ, কৃষি বিষয়ক নানা পরামর্শ নিয়েছিলেন। পরামর্শ নেয়ার পাশাপাশি তিনি নিজের একখন্ড জমিতে শুরু করেন জৈব পদ্ধতিতে সবজি চাষ করার, পুকুরে মাছ। এভাবে কোহিনূর বেগমের জীবন সংগ্রাম সূত্রপাত হয়।
এ জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়ার জন্য তাঁর চিন্তার পরিধি বেড়ে গেলো; কিভাবে জীবনে উন্নয়ন করা সম্ভব হবে! কোথায় গেলে সহযোগিতা পাওয়া যাবে, কি করলে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া যাবে; নানান চিন্তা তাঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। উপায় তিনি পেয়েছেন। তাইতো তিনি নিয়মিত কৃষি অফিস, মৎস্য অফিস, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ নেওয়ার জন্য। বিভিন্ন এনজিও ও সংগঠনের সাথেও যোগাযোগ করতে শুরু করলেন। তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে তিনি শুরু করলেন সমন্বিত উন্নয়ন উদ্যোগ। যেখানে শুধুমাত্র নিজের উন্নয়ন নয় বরং সবজি চাষ, মৎস্য চাষসহ সমন্বিত কৃষি চর্চার মাধ্যমে কিভাবে কিভাবে অসহায় মানুষের পাশে থাকা যায়, তাদের উপকার করা যায় এবং কিভাবে সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখা যায় সে বিষয়ে তিনি যথেষ্ট সজাগ ছিলেন। তাই তো কোন ভালো কাজ বা উদ্যোগকে তিনি অবহেলার চোখে দেখেননি। সমন্বিত কৃষি চর্চার মাধ্যমে তিনি আজ সফল। এই সফলতার গল্প তিনি অন্যের মধ্যেও সঞ্চার করার চেষ্টা করেন। উৎপাদিত ফসল অন্যান্যদের সাথে ভাগাভাগি করেন যাতে তারাও অনুপ্রাণীত হয়; তৎপর নিজের উন্নয়ন সাধনে!
বর্তমানে সবজি চাষ, মাছ চাষসহ হাঁস মুরগি পালনের মাধ্যমে তিনি যেমন তাঁর পারাবারিক চাহিদা পূরণ করেছেন পাশাপাশি আর্থিকভাবেও লাভবান হচ্ছেন। তবে তিনি এখনও ক্ষান্ত নন! তিন চান আর্থিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখার। সঙ্গত কারণেই তিনি নারী নির্যাতন ও বাল্য বিবাহ রোধে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবক, এমনকি ছেলে মেয়েদের সচেতন করান। এসব সামাজিক ব্যাধির কুফল সম্পর্কে তাদের অবহিত করেন। শুধু তাই নয়; এলাকার বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি সরকারি ও বিভিন্ন বেসরকারি সেবা ও পরিসেবা লাভের জন্য সরকারি ও বেসরকারি দপ্তরে যোগাযোগ করেন। তাঁর সফল যোগাযোগ ও নেতৃত্বের কারণেই এলাকায় একটি পানির ফিল্টার তৈরি সম্ভব হয়েছে।
বর্তমানে কোহিনূর বেগম সোনমিুগারী জেলে কল্যাণ সমবায় সমিতির একজন সক্রিয় সদস্য। সমিতিরি সদস্যদের সাথে নিয়ে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বারদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করে এলাকার কাচা রাস্তাটিতেও ইট বসানোর কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছেন। জৈব কৃষি চর্চার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও উপকরণ সহজলভ্য করার জন্য বর্তমানে তিনি নিজ বাড়িতে উন্নত জাতের কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরি করছেন। উৎপাদিত এ সার তিনি নিজের জমিতে ব্যবহার করছেন এবং অন্যকেও উৎসাহিত করেছেন, পরামর্শ ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সাহায্য করেছেন এ সার তৈরি করার জন্য। তাই তো তাঁর দেখাদেখি এলাকায় অনেক কৃষাণ-কৃষাণী রাসায়নিক সার ব্যবহার কমানোর জন্য বা ত্যাগ করার জন্য বাড়িতে কেঁচো কম্পোস্ট সার তৈরি করছেন। তাঁর সংগ্রাম, সফলতা এবং জনকল্যাণের জন্য তার ভূমিকার কারণে এলাকায় তিনি খুব জনপ্রিয়। যেকোন ভালো কাজের জন্যই মানুষ তার কাছে যান পরামর্শ নেওয়ার জন্য। তিনিও চেষ্টা করেন মানুষকে তার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান সহভাগিতার জন্য।
কোহিনূর বেগমের স্বপ্ন দেখেন সবাইকে নিয়ে নিজ নিজ এলাকার উন্নয়নে ভূমিকা রাখার। বাইরে কারও ওপর নির্ভরশীল না থেকে নিজের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়েই তিনি এ উন্নয়ন ঘটাতে চান। তিনি উপলদ্ধি করেন নিজের ওপর বিশ্বাস থাকলে এবং আত্মবিশ্বাসী হলেও সবাইকে নিয়ে এ উন্নয়ন করা সম্ভব। তিনি তো তাঁর উদ্যম ও ইচ্ছাশক্তির গুণেই পরিবারের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা আনায়ন করেছেন। তাই সবাইকে নিয়ে এগুলে অবশ্যই তিনি তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছাতে পারেন বলে তিনি বিশ্বাস করেন। এই কারণে তিনি ভবিষৎতে নারী নেতৃত্ব বিকাশ ও সঠিক কাজে লাগানোর জন্য ইউপি নিবাচনে অংশগ্রহণ করবেন বলে জানান। তাঁর দেখাদেখিতে যেন সবাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজের উন্নয়নে কাজ করেন।