নারীদের কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে
মানিকগঞ্জ থেকে ঋতু রবি দাস
‘নারী’ জাতিকে নিয়ে যুগ যুগ ধরে কত গান, কত কবিতা রচিত হয়েছে। সকল ধর্মেই নারীদের বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ‘জননী জন্মভূমি, স্বর্গাদপী গরিয়সী’ অর্থাৎ জননী স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। সকল ধর্মেই নারী জাতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে।
আমি বারসিক-এ যোগদান করি ২০২১ সালের ১লা জানুয়ারি। যখন আমি ৮ম শ্রেণিতে পড়ি তখন থেকেই বারসিক‘র’ বিভিন্ন আয়োজনে অংশগ্রহণ করতাম। বারসিক নারীদের নিয়ে, আমাদের অধিকার নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতো। তাই কৈশোর বয়স থেকেই এগুলো জানার প্রতি আমার আগ্রহ ছিলো। বারসিক‘এ’ যোগদান করেছি ২ বছর শেষ হলো। প্রতিনিয়ত আমি নতুন কিছু জানছি। যে যেভাবেই বলি, নারী জাতিকে যতই আমরা উপরে রাখি, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তারা এখনও অবদমিত, অবহেলিত, উপেক্ষিত। পরিবার, সংসার, সমাজ প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা পুরুষদের মাধ্যমেই পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। সুতার সূক্ষ্ম টান কোন না কোন পুরুষের হাতেই থাকে। একজন নারী একটি পরিবার বা তার সংসারে কত কাজ করে, এটা একজন নারী নিজেও বলতে পারবে না। তাই তো কোন নারীকে জিজ্ঞেস করবেন যে আপনি কি কাজ করেন, তাদের সচরাচর একটাই জবাব, আমরা কোন কাজ করি না। যারা চাকুরিজীবি তারা বলেন, আমরা চাকুরি করি।
কিছুদিন হলো নারী এবং পুরুষের কাছ থেকে আমরা তাদের পারিবারিক কাজের একটা ধারণা নেওয়ার জন্য, একটা সার্ভে করি। সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকে এবং রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত একজন নারী এবং পুরুষ কি কি কাজ করেন, তার একটা তালিকা তৈরি করি। আমরা বিভিন্ন বয়সের এবং পেশার নারী পুরুষের সাক্ষাৎকার নিই। যখন তাদের কাছে জিজ্ঞেস করা হয়, তারা বাসায় কি কি কাজ করেন, সবারই একটাই উত্তর যে, আমরা কিছুই করি না তবে পুরুষের ভাষ্য ছিলো ভিন্ন।
যখন বলি যে সকালে ঘুম থেকে উঠে আর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আপনারা কি কি কাজ করেন, সেগুলো একটু বলেন আমি লিখব। তখন তারা বলেন, মহিলা মানুষগো আর কাম কি, রান্না করি আর খাই এইডাই আমাগোর কাজ। আমি বললাম সেগুলোই বলেন, আমি শুনি। তখন তারা বলতে শুরু করেন, তাদের সবারই ভোর ৫টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠতে হয়। রান্না থেকে শুরু করে, খেতে যাওয়া, ঘাস কাটা, গরু ছাগল খাওয়ানো, ঘর উঠান ঝাড়– দেওয়া, বাচ্চাদের জন্য টিফিন তৈরি, তাদের স্কুলের জন্য রেডি করা সব তাদের একা সামলাতে হয়। বাসার পুরুষরা সকালে উঠে খেয়েই যে যার মত কাজে চলে যায়। একজন নারী বাসার কাজ শেষ করেও নিজের হাত খরচের জন্য পাঞ্জাবি সেলাই, শাড়ি সেলাইয়ের কাজ করেন। অনেকেই বলেন যে, আমরা যদি কিছু টাকা আয় করি, সেগুলোর হিসেবও স্বামীদের দিতে হয়। দেখা যায়, আমরা এই টাকাগুলো সংসারের কাজেই ব্যয় করি। আমি তখন বললাম, এই যে আপনারা বললেন আপনারা কোন কাজই করেন না। তখন তারা বলেন যে, সবাই তো তাই বলে, যে আমরা কোন কাজ করি না। আমি তাদের তখন বলি যে, আপনারা যে কাজগুলো করেন, সেগুলোকে বারসিক‘র’ ভাষায় ব্যয় সাশ্রয়ী কাজ বলে। তখন তারা বলেন যে, মানে কী, তখন আমি বললাম এই কাজগুলো যদি বাসায় এসে গৃহপরিচারিকা করতো, তখন তাদের কি টাকা দিতে হতো না? তারা বললেন অবশ্যই দিতে হতো। আপনাদের তো কোন পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না, এগুলো আপনারা বিনামূল্যে করে থাকেন, তাই এটাকে আমরা ব্যয় সাশ্রয়ী কাজ বলা হয়। এখন আপনারাই ভেবে দেখুন, আপনারা কোন কাজ করেন কি না! আসলে সমস্যাটা হলো আপনারা নিজেরাই জানেন না, একটা সংসারে নারীদের গুরুত্ব কতটুকু!
একটা বহুত্ববাদী সমাজ নির্মাণে অবশ্যই নারীদের ভূমিকাকে প্রাধান্য দিতে হবে, তাদের কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে। দিনশেষে বলতেই হবে, তুমি না থাকলে আসলেই আমার সংসারটা অগোছালো থাকত। যেই দেশে অর্ধেকের বেশি নারী সেই দেশ নারীদের ছাড়া এগুতে পারবে না। তাই নারীদের এগিয়ে নিয়ে যেতে পুরুষদের সাহায্য করতে হবে।