সাম্প্রতিক পোস্ট

প্রকৃতি কন্যার গায়ে হলুদ

প্রকৃতি কন্যার গায়ে হলুদ

আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ)

“হলুদ বাঁটিছে- হলুদ বরণী মেয়ে,
রঙিন ঊষার আবছা হাসিতে আকাশ ফেলিল ছেয়ে।
মিহি-সুরী গান -গুন গুন করে ঘুরিছে হাসিল ঠোঁটে”

পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের এমন বর্ণনার মতোই যেন মানিকগঞ্জে হলুদ চাঁদরে ঢেকেছে দিগন্ত বিস্তৃত প্রকৃতি। মাঠে মাঠে চোখ জুড়ানো হলুদ ফুলের সমারোহ। ঋতু পরিবর্তনের সাথে বদলে গেছে প্রকৃতির রূপ। প্রান্তরজুড়ে উঁকি দিচ্ছে সরিষা ফুলের দোল খাওয়া গাছগুলো। সরিষার সবুজ গাছের হলুদ ফুল শীতের সোনাঝরা রোদে ঝিকমিকিয়ে উঠছে। এ এক অপরূপ সৌন্দর্য। যেন প্রকৃতি কন্যা সেজেছে “গায়ে হলুদ বরণ সাজে”।

Ghior pic 1 (1)রাজধানীর পাশ্ববর্তী জেলা মানিকগঞ্জের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠজুড়ে যতদূর চোখ যায়, এলাকাজুড়ে সরিষার আবাদ। হলুদ ফুলে ফুলে ভরে আছে বেশিরভাগ ক্ষেত। ফুলের মৌ মৌ গন্ধ সুবাস ছড়াচ্ছে পুরো এলাকা। আকৃষ্ট করছে মৌমাছিসহ সব প্রকৃতি প্রেমিককে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে ফলন ভালো হবে বলে আশা করছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা। আপন মহিমায় সেঁজেছে বর্ণিল সাঁজে। হলুদ রংয়ের আভার সাথে বাতাসে বইছে মৌ গন্ধ। মৌমাছি ব্যস্ত মধু সংগ্রহে। আর নয়নাভিরাম এ দৃশ্য দেখতে প্রকৃতি প্রেমিরা সপরিবারে ভীড় করছেন উপজেলার বিভিন্ন মাঠে।

বর্তমান সময়ে সরিষা ক্ষেতগুলোর কোন কোন জায়গায় মধুচাষিরা বসেছেন মধু সংগ্রহের জন্য। কুয়াশায় ধূসর প্রান্তর, তাও চারদিকে হলুদের সমাহার। মনে হয় যেন রূপকথার রাজকুমারীর গায়ে হলুদ। সবাই কনেকে হলুদ দিতে উপস্থিত। উপস্থিত থাকে প্রজাপতি, মৌমাছি, হলুদিয়া-নীলরঙা পাখি, পোকামাকড় থেকে শুরু করে রাজ্যের প্রজারা।

Ghior pic 1 (2)ক্ষেতে ক্ষেতে মৌমাছির গুঞ্জরণ যেন গানের রেশ সৃষ্টি করেছে। এদিকে মৌচাষিরাও ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন মধু সংগ্রহে। এবার জেলায় প্রায় ৩৫ টন মধু সংগ্রহ করা সম্ভব হবে, এমনটাই আশা মৌচাষি ও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের। জেলার কৃষকেরা বুঝে গেছেন মৌমাছি মধু সংগ্রহ করলে পরাগায়নের মাধ্যমে ফসল ভালো হয়। তাই মওসুমি মৌচাষিরা আসায় জেলায় সরিষার ফলন বৃদ্ধি পাবে প্রায় ১৫ শতাংশ। জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধির জন্য এর ফুল ও পাতা ঝরে তৈরি করা হয় জৈব সার। ফলে মানিকগঞ্জ জেলার অনেক কৃষক এখন ধান ও অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি সরিষা চাষের দিকে ঝুঁকছেন।

ঘিওরের সিংজুরী গ্রামের প্রান্তিক কৃষক মফজেল শেখ জানান, তার চার একর জমিতে সরিষা আবাদ করে ব্যাপক সাফল্য, পেয়েছেন। গত ১০ বছর ধরে আবাদযোগ্য জমিতে সরিষাচাষ করে প্রতি মওসুমে ২০-৩০ হাজার টাকা করে অতিরিক্ত লাভ করছেন। চলতি মওসুমে সরিষার ফলন ভালো হলে আরো বেশি লাভ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

এদিকে বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন মৌচাষিরা। জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জামালপুর, গাজীপুর, পাবনা, সাতক্ষীরা, নারায়ণগঞ্জ, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকে শতাধিক মৌচাষি মানিকগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরষে ফুল থেকে বিশেষ কায়দায় মধু সংগ্রহ করছেন। তাদের সংগৃহীত মধু রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিক্রি হয়ে থাকে।

মানিকগঞ্জ জেলা কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম জানান, সঠিক সময়ে ভালো বীজ বুনলে এবং প্রয়োজনীয় সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করে আগাম ফলন ফলিয়ে তা বাজারজাত করতে পারলে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে অধিক লাভ করা সম্ভব। এক বিঘা সরিষা চাষ করতে খরচ হয় এক থেকে দেড় হাজার টাকা। ভালো ফলন হলে বিঘায় চার-পাঁচ মণ সরিষা পাওয়া যায়। তিনি আরো জানান, বছরের নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সরষে ফুল থেকে মধু সংগ্রহ চলে। এ সময়ে গড়ে একেকজন মৌচাষি প্রতি মাসে ২০ থেকে ২৫ মণ মধু আহরণ করতে পারেন। চলতি বছর জেলার বিভিন্ন স্থানে মৌচাষিরা সরিষা ফুল থেকে প্রায় ৩০ টন মধু সংগ্রহ করবেন, যার পা ইকারি মূল্য ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা।

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশেই সরষে ক্ষেতে মধু সংগ্রহের সরঞ্জাম নিয়ে বসেছেন সাতক্ষীরা জেলার জব্বার মিয়া ও মো. রবিন। তারা জানান, মধু সংগ্রহ করে তাদের সাবলম্বী হওয়ার কাহিনী। তাদের বাক্সের সংখ্যা ১০০ কাছাকাছি। প্রতি মণ মধু ৮-১০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন ঢাকার যাত্রাবাড়ী ও আশুলিয়ার এক পাইকারের কাছে। তারা আরো বলেন, উন্নত প্রশিক্ষণ আর সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মধু সংগ্রহের কাজে উন্নতি করা যাবে। দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রফতানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, মানিকগঞ্জে এবার প্রায় ৪২ হাজার ৫শত হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৮০ হাজার টন। সরকার বারি ১৪ জাতের বীজ সরবরাহ করায় এবার ফলন ভালো হয়েছে। জেলায় ৩৫ টন মধু সংগ্রহ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ঘিওর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আশরাফ উজ্জামান জানান, এ এলাকার জমি বেলে, দোআঁশ হওয়ায় পানি ধারণের ক্ষমতা কম। পানি ধারণ ক্ষমতার জন্য জমিতে জৈব সারের প্রয়োজন। সরিষা চাষ করলে খাবার তেলের চাহিদা পূরণসহ পাতা ও ফুল পড়ে জৈব সার তৈরি করে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে।

happy wheels 2

Comments