সুপেয় পানি নিশ্চিতকরণে শ্যানগরের যুবদের উদ্যোগ

সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল

পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া পৃথিবীতে কোন প্রাণই বেঁচে থাকতে পারেনা। উপকূলীয় এলাকায় পানি আছে পর্যাপ্ত কিন্তু সুপেয় পানির মারাত্মক সংকট। ভৌগলিক ও কৃষিপ্রতিবেশগত ভিন্নতার কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানি লোনা। অপরদিকে নদী কূলবর্তী হওয়াতে উপকূলীয় দক্ষিণ অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দূর্যোগের মাত্রাও একটু বেশি। একদিকে প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর অন্যদিকে মানব সৃষ্ট আপদের কারণে উপূুলীয় এলাকায় পানি লবণাক্ততায় পরিণত হচ্ছে। এলাকাতে কৃষি উপযোগী পানির উৎস বলতে ভূগর্ভের উপরিস্থ ডোবা, নালা, খাল, ও পুকুরের পানি। প্রাকৃতিক ও মানব সূষ্ট দূর্যোগের সাথে মোকাবিলা করে টিকে আছে এখানকার মানুষ। খাওয়ার পানির সংকট মোকাবেলায় নানা ধরনের প্রচেষ্টা আব্যাহত রেখেছেন।

pic-3

এলাকার মানুষের খাওয়ার পানির একমাত্র উৎস পুকুরের পানি। এজন্য বর্ষায় পুকুরে পানি সংরক্ষণ রেখে তা সারাবছর খাওয়ার কাজে ব্যবহার করেন। তেমনি শ্যামনগর উপজেলার সদর ইউনিয়নের যাদবপুর ও মাহমুদপুর গ্রামে দু’টি পুকুর আছে। যেটি প্রতিদিন প্রায় ১৬০০ পরিবারের সুপেয় পানির নিরাপত্তা প্রদান করে। ১৯৯২ সালের দিকে পুকুর দুটি খনন করা হয়। খননেনর পর থেকে আশেপাশের প্রায় ১২টি গ্রামের মানুষ পুকুর দু’টি খাওয়ার পানির উৎস হিসেবে ব্যবহার করছেন। ১৯৯২ সালের পর ২০০৩ সালের দিকে পুকুর দুটি আবার পুনঃখনন করা হয়। এরপর সর্বশেষ ২০০৫ সালে স্থানীয় জনগণ ও স্থানীয় সরকার পুকুরটির চারপাশ সুন্দরভাবে বাঁধ দিয়ে, পাড় উচু করে। কিন্তু সুষ্ঠু ব্যবহার বা আলাদা কোন কমিটি না থাকায় অবাধে পুকুরে মানুষ ও গবাদি পশুর প্রবেশে পুকুরের পাড় ভাঙ্গা, থালা বাসন ও গোসলের কারণে পুকুরের পানি ও পরিবেশ নষ্ট। এছাড়া সংস্কার না করায় পিএসএফগুলো অকেজো হতে থাকে। ফলে মানুষের বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তি তৈরি হতে থাকে।

pic-2

পরবর্তীতে ২০১১ সালের দিকে বিষয়টি গ্রামের যুবরা অনুধাবন করে যে এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সমস্যা সমাধানের জন্য পুকুরগুলো সংস্কার করা প্রয়োজন। এক পর্যায়ে সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিমের যাদবপুর ইউনিট প্রধান কামরুল ইসলাম বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় মানুষদের সাথে কথা বলেন এবং নিজের টিমের মাসিক সভায় ও উপজেলা পর্যায়ে সভায় বিষয়টি সহভাগিতা করেন। সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিম স্থানীয় জনগণের চাহিদা অনুযায়ী পুকুর সংরক্ষণ ও এবং যাদের পুকুরের পাশে বসবাস তাদের কয়েকটি পরিবার মিলে একটি করে টিউবওয়েল বসানোর বিষয়ে আলোচনা করে এবং তাদের সহযোগিতা কামনা করে। পরে স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিম পুকুরটি সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করে। বারসিক পক্ষ থেকে সংরক্ষনের জন্য উপকরণ নেট ও দুটি ট্্্উবিওয়েল সহায়তা করা হয়। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে টিউবওয়েল এবং স্থানীয় জনগণের পক্ষ থেকে বাঁশ, জিবলির কচা, পরামর্শ লাভ করে যুবরা। এসব উপকরণ দিয়েই স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিমের সদস্যরা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে পুকুর পুকুর সংরক্ষণে চারিপাশে ঘেরা ও টিউবয়েল স্থাপনের কাজ সম্পন্ন করে। যাদবপুর ও মাহমুদপুর গ্রামের যুবরা পুকুর দুটি সংরক্ষণে বিভিন্ন উদ্যোগ চলমান রেখেছে।

pic-1

এভাবে কখনো স্থানীয় সরকার, উপজেলা প্রশাসন, এলাকায় বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ রেখে যুবরা সুপেয় পানির উৎস সংরক্ষণে ভূমিকা রাখছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় চারপাশে ঘিরতে নেট, টিউবওয়েল, পিলার, কটসুতা, পিএসএফ সংস্কার, পানি সংগ্রহে যাতায়াতের রাস্তা তৈরি ও সংস্কার করতে সক্ষম হয়েছে যুবরা। গত ২১ জুলাই মাহমুদপুর ও যাদপুর গ্রামের প্রায় ৭৫-৮০ জন যুব একত্রিত হয়ে পুকুুেরর চারিপাশ, পিএসএফ পরিস্কার ও সংস্কার করেছে এবং নিজেদের মধ্যে থেকে চাঁদা উঠিয়ে একসাথে দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করেছে।

pic-5

এ বিষয়ে যাদবপুর ইউনিট প্রধান কামরুর ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বাপ দাদাদের আমলের এ পুকুর এলাকার অনেক গ্রামের মানুষ এখান থেকে পানি নিয়ে যায়। এখানকার অনেক পরিবার এ পানি বিক্রি করে সংসার চালায়। এছাড়াও সুপেয় পানির তেমন কোন উৎস তো নেই আমাদের। তাই এ পুকুর দুটি সংরক্ষণ করা খুবই জরুরি। এছাড়াও পানি সংরক্ষণ ভূমিকা রাখায় এলাকার মানুষ আমাদের এ কাজের সাথে সহমত পোষণ এবং প্রসংশা করেছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সচেতনমূলক কাজ যেমন বিভিন্ন আলোচনা, সাংস্কৃতিক ও বিনোদন, নবীন ও প্রবীনদের গল্পের আসর, দেওয়াল লিখন, যুবদের দূর্যোগে সক্ষমতা তৈরি বিষয়ক প্রশিক্ষণ এর ফলে যুবদেরকে আগ্রহী ও সচেতন করা হচ্ছে। এর মধ্যে অনেক যুবক মাদকাসক্ত থেকে ফিরছে এটা অনেক বড় পাওয়া।’

pic-7

যুব টিমের সদস্য আব্দুল কাদের, আরিজুল, আফজাল, লিটন, আবুজাররা জানান, তারা সব সময় ভালো কাজের জন্য স্বেচ্ছাশ্রম দিতে প্রস্তুত। তাদের যে সম্পদ আছে তার সঠিক ব্যবহার করা উচিৎ। পানি সংগ্রহ করেত আসা দেবীপুর গ্রামের গীতা রানী ও রনো মন্ডল বলেন, ‘আমাদের গ্রামে অনেকে টিউবওয়ের বসিয়েছে কিন্তু তার পানি ব্যবহারযোগ্য নয়। আমাদের এখানে না আসে কোন সাপ্লাই না আসে ভালো কোন ব্যবস্থা। আমরা বর্ষার দু’মাস বাদ দিয়ে বাকী সময় প্রায় এখান থেকে পানি সংগ্রহ করে প্রয়োজন মিটাই। যুবকেরা যে পুকুর দুটি এখনো ব্যবহার উপযোগী করে রেখেছে তার জন্য ধন্যবাদ তাদের।’

pic-4

পানির সঙ্গে প্রত্যেক প্রাণের সম্পর্ক রয়েছে। এই প্রাণের সম্ভার বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দূর্যোগের শিকার। এ দূর্যোগের ফলে এলাকার সুপেয় পানির উৎস ক্রমান্বয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে পুকুরে পানি সংরক্ষণ এবং সুপেয় পানি নিশ্চিৎকরণে যুবদের এ উদ্যোগ প্রসংশনীয়।

happy wheels 2

Comments