আমাদের অভ্যাস, কমাতে পারে পানি বঞ্চিতদের দীর্ঘশ্বাস
নেত্রকোনা থেকে রনি খান
নেত্রকোনার কলমাকান্দা সীমান্ত দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আপনি হয়তো প্রত্যক্ষ করতে পারেন নতুন ধরনের এক ‘পানি সংগ্রামের’। কলমাকান্দার সীমান্তবর্তী আদিবাসীদের পানি সংগ্রহের কৌশল হয়তো আপনাকে মনে করিয়ে দিতে পারে কারবালার ময়দানকে। খুলনা থেকে সুনামগঞ্জ, কয়রা থেকে কলমাকান্দা পানিবন্দি মানুষের খাবার পানির জন্য হাহাকার এখানকার মানুষের এক নিত্য চিত্র। প্রতি বৈশাখে হাওর অঞ্চলের মানুষের ধান ও জান রক্ষার জন্য যেমন পানির ভয় থাকে তেমনি প্রতি চৈত্রে থাকে খাবার পানির ভয়। একদিকে যখন কেউ সুইচে টিপে অথবা ফ্রিজের ডালা খুলে এক ঢোক তৃপ্তির পানি অনায়াসে পান করে অন্যদিকে তখন হয়তো কেউ এক কিলোমিটার পায়ে হেটে বিত্তশালিদের গঞ্জনা সয়ে সংগ্রহ করে এক কলস পানি। একদিকে যখন কেউ আড়াই লাখ টাকায় পান করছেন এক লিটার পানি অন্যদিকে তখন পানিরই অভাবে আত্মহত্যা করছে ‘দেশমাতারই মুক্তিকামী’ কৃষক। পানি প্রাপ্তির এই বৈষম্যের কথা ভাবতে ভাবতে আপনি একবার চোখ বুলাতে পারেন পানি আইন ২০১৩ তে যেখানে বলা হয়েছে- ‘পানির সকল অধিকার রাষ্ট্রের উপর অর্পিত থাকবে।’ একই সাথে চোখ রাখতে পারেন জাতীয় পানি নীতি ১৯৯৯ এর উপর। যেখানে এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘ দরিদ্র ও অনগ্রসর অংশসহ সমাজে সবার জন্য পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ এবং নারী ও শিশুদের বিশেষ প্রয়োজনের প্রতি মনোযোগ দেয়া’ এবং একই সাথে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ছয় নাম্বার লক্ষ্যমাত্রাটিতে যেখানে ‘পানি এবং স্যানিটেশন’র কথা বলা হয়েছে।
জাতিসংঘ থেকে স্থানীয় সরকার সর্বত্রই যখন ‘পানি’র বিশেষ গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে- ঠিক তখনই উপকূলীয় অঞ্চল কিংবা হাওর অঞ্চলের বাসিন্দাদের পানি সংগ্রাম আপনাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। একই সাথে আপনি ভাবতে বাধ্য হবেন- শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় দায়িত্বেই সবার জন্য পানির সহজ প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সেজন্য আপনার-আমার সকলের যার যেটুকু করার আছে- সেটুকুই করতে হবে। জাতিসংঘ ২০২৩ সালের বিশ^ পানি দিবসের প্রচারণায় তাই এই বিষয়টিকে যুক্ত করেছে। ধারণা করা হচ্ছে- ইউক্রেন বনাম রাশিয়ার যুদ্ধের কথা বাদ দিলে তৃতীয় বিশ^ যুদ্ধের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে ‘পানি’। পানির এই গুরুত্বকে স্বীকার করেই গানের দল গানওয়ালা ‘কল্পলোকের ঘুড়ি’ শিরোনামের একটি গানে গেয়েছে ‘পানির জন্য লাগবে যুদ্ধ/ পানি পাবে না।’ পানির উপর কোম্পানি বাণিজ্যের কর্তৃত্ব পুরোমাত্রায় করগত হলে কিরকম হতে পারে তার একটি ক্ষুদ্র চিত্র গেলো বছর মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতীয় সিনেমা ‘সর্দার’ এ দেখানো হয়েছে।
দুনিয়ার প্রকৃত ঘনিষ্ঠ প্রাকৃতজনের পানির জন্য সংগ্রাম অনাদিকালের। দুনিয়ার নগর-গ্রাম, সংস্কৃতি-আচার-অনুষ্ঠান, জীবন যাপনের রীতি, প্রাচুর্য-বিত্তহীনতা সব কিছুই গড়ে উঠেছে পানিকে কেন্দ্র করে। পানির সাথে প্রাণের এই সম্পর্ক আদি ও আসল। তবে, মুক্তবাজার অর্থনীতি দুনিয়ার অন্য সকল কিছুর মতো পানির সাথে প্রাণের সম্পর্ককেও বিষিয়ে তুলেছে। প্রাণবিদ্বেষী প্লাস্টিকের বোতলে তথাকথিত ‘বিশুদ্ধ’ পানির বাজারজাত করে নি¤œ আয়ের প্রান্তিক মানুষকে করে তুলছে আরো প্রান্তিক। যখন বিত্তশালীদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠিত ‘সেলিব্রেটি’রা ‘বিশুদ্ধ’ পানির বিজ্ঞাপন এবং পানি বিশুদ্ধকরণের প্রক্রিয়া মানুষকে বাতলে দেন তখন আমাদের স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে প্রকৃতি’র পানিকে অশুদ্ধ করলো কে? যে অতিবেগুনি রশ্মি থেকে পানিকে বিশুদ্ধ করার কথা বলা হচ্ছে সেই অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে আনলো কারা? বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো যে প্লাস্টিক-পলিথিনের ভাগাড় হয়ে উঠছে, সেই প্লাস্টিক পলিথিনের বাজারজাত করে কারা? পানির জন্য সংগ্রাম করা প্রান্তিক মানুষেরা নিশ্চয় সেই জন্য দায়ী নয়। নদী-পানি-বায়ু-মাটি দূষিত করে আবার সেই দূষণকেই পুঁজি করে ব্যবসা যারা করছে তারাই তো সুইচে টিপে পানি খাচ্ছে, সরকারের ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে বিদেশে গড়ছে নিশ্চিত জীবন।
জাতিসংঘের পানি বিষয়ক সংস্থা স্বীকার করছে যে, পৃথিবী এখন পানির ‘ক্রাইসিস’ এ আছে। সেই ‘ক্রাইসিস’ মোকাবেলায় আমাদের সবারই নিজস্ব জায়গা থেকে কাজ করতে হবে। আমাদের একটাই পৃথিবী। এই পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখতে হলে- প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং ব্যবহারে আমাদের সবাইকেই সংবেদনশীল হতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে- আমাদের সন্তানেরাও এই পৃথিবীতেই বসবাস করবে। তাদের জন্যেও আমাদেরকে পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করে রেখে যেতে হবে। ভোগবাদের যামানায় ভোগের কাছে আত্মসমর্পণ না করে সকলকে নিয়েই আমাদেরকে পৃথিবীতে বাঁচতে হবে। সেজন্য পানি ব্যবহারে আমাদেরকে আরো সতর্ক হতে। পানি ব্যবহারের অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। তবেই পানি দিবস পালনের সার্থকতা আসবে।