একটি গভীর নলকূপের আত্মকথাঃ এ অঞ্চলের খাল খাড়ি সংরক্ষণ করুন
বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার
ভূমিকা
বাংলাদেশের মধ্য একটি অঞ্চল আছে বরেন্দ্র অঞ্চল সেখানেই আমার বাস। আমার জন্ম বরেন্দ্র বহুমূখী উন্নয়ন কতৃপক্ষ (বিএমডিএ) হাত ধরে সেই ১৯৮৫ সালের কিছু পড়ে। আমার কাজ হলো মাটির নিচ থেকে পানি তোলা, শুধু পানি তোলা। আমাকে সৃষ্টির একটাই লক্ষ্য ছিলো বৃহৎ এ অঞ্চলের অনেক অনাবাদি জমি সেচের আওতায় এনে কৃষি উৎপাদন বাড়ানো। কারণ এই এ অঞ্চল যে পানির জন্য সব সময় হাহাকার করেছে। আর সেই অতীত থেকে নাকি এই অঞ্চলে বৃষ্টি নির্ভর আমন ছাড়া কোন ধান হতো না। বছরের অন্য সময় কালাই, মসুর, মটর, যব ছারা কোন কিছুই আবাদ হতো না। যা হোক এখন আসি নিজের কথায়। আমাকে মানুষ চিনে পানি তোলার যন্ত্র হিসেবেই। আমার অবস্থান বরেন্দ্র অঞ্চলের আনাচে কানাচে। আমাকে দেখলেই চেনা যায় আমি গভীর নলকূপ। কেউ আমাকে ডাকে ডিপ আবার কেউ ডাকে পানি তোলার মটর বলে। আমার কাছে মানুষ আসে শুধু পানি নিতে। ধানের জন্য পনি, আলুর জন্য পানি, পুকুরে মাছ চাষের জন্য পানি, শুধু পানি আর পানিই চায় মানুষ। আমারও যে কিছু কথা আছে তা কেউ শুনতেই চায় না। আজ বলার সুযোগ পেয়েছি আজ বলব আমর দুঃখ সুখের কথা।
আমার অতীত
কোন বড় মাঠ যেখানে ফসলের চাষ হয় সেখান তাকালেই আমাকে দেখা যায়। একটি ইট পাথরের ঘরেই আমার অবস্থান। এই ঘরের মধ্যই মাটির বুঁক চিরে ৫০০-৭০০ ফিট গভীর পর্যন্ত পাইপ পোঁতা আছে। যা দিতে মাটির বুঁক শোষন করে পানি তোলার ব্যবস্থা করা হয়। আমার জন্মের পর থেকে শুধু দেখতাম বোরো চাষের সময় পানি তোলা হতো। বাকি সময় কৃষকরা বৃষ্টির পানি দিয়েই নিজেদের কাজ চালিয়ে দিত। আহা কি ভালো ছিলো সে সময় গুলো। বছরের যেটুকু সময় মাটির নিচ থেকে পানি তুলতাম। অন্য সময় বৃষ্টির পানিতে মাটির নিচে আবার তা পূরণ হয়ে যেতো। কৃষকদের যখন প্রয়োজন হতো তখন এসে প্রয়োজন মতো পানি তুলত। আমি এ অঞ্চলের জমিগুলোকে ফসলে ভরপুর রাখতে সহযোগিতা করেছি। তখন আমার মুখ দিয়ে অনেক পানি বেড় হতো তাই কম সময়েই কৃষকদের প্রয়োজন মিটে যেত। আমার থেকে সাধারণ কৃষকদের পানি নিতে কোন দিন সমস্যাতেই পড়তে হয়নি। আমার বয়স যখন অল্প তখন দেখতাম এ অঞ্চলের পুকুরগুলোর পানি দিয়ে মানুষেরা নিজের দৈনন্দিন কাজ সেড়ে নিত। আমি এও দেখেছি পুকুর পানি মানুষ ও গৃহপালিত পশুর খাওয়ার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। আমি শুনেছি অনেক আগে এ অঞ্চলে একজন রানী ছিল যার নাম রানী ভবানী তিনি নাকি মানুষের খাবার পানির কষ্ট নিবারনের জন্য ৫৭০টি বড় বড় দিঘী খনন করেছিল। কত ভালো ছিলো সে দিনগুলো। আমি আরও দেখেছে কত শত ছোট বড় পুকুর ছিলো। কিন্তু আস্তে আস্তে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প এবং নানাবিধ কারণে সে পুকুরগুলো ভরাট করে দিয়ে আরো বেশি আরো বেশি সংকট করে তুলেছে এ অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনা।
আমার বর্তমান
দিন যত যাচ্ছে তত মানুষের পানির প্রয়োজন হচ্ছে। সারা বছর পানির প্রয়োজন হচ্ছে কারণ এখন সারা বছর জমিতে ফসল চাষ হচ্ছে। বেশি বেশি পানির প্রয়োজন হয় এমন ফসল চাষেই আনুষকে আগ্রহী করে তোলা হচ্ছে। কোন পরিকল্পনা নেই কোন চিন্তা নেই। এখন মানুষের শুধু চিন্তা বেশি বেশি পানি তুলতে হবে। আর এত পানি তুলতে তুলে আজ আমি ক্লান্ত। আমি আর বেশি পানি তুলতে পারি না। পারবই বা কি করে দিনে দিনে যে মাটির বুঁকেও পানি শূন্যতা হয়ে যাচ্ছে। এখন পানি শুধু মাটির নিচেই নেমে যাচ্ছে। আগের মতো বৃষ্টি নেই বলে মাটি তার হারানো পানি পূরণ করে নিতে পারছে না। আগে দেখতাম আমনের মৌসুমে ধান চাষে আমার থেকে কোন পানি নিতে হতো না। কিন্তু কয়েক বছর থেকে দেখছি আমনের শেষে গিয়ে আমার থেকে পানি না নিলে আমন ধান পুষ্ট হচ্ছে না। এবার বৃষ্টি নেই বলে আমনের শুরু থেকেই আমার থেকে পানি নিতে হচ্ছে। এ বছর কৃষকরা সারা বছর আমার থেকে পানি নিয়েছে। এমনকি এ অঞ্চলে আমন ধান হতো সকল জমিতে এবার অনেক জমি পড়ে থাকছে পানির অভাবে। বৃষ্টি নেই আর আমিও আগের মতো পানি তুলতে পারছি না। লোকে বলে জলবায়ু নাকি পরিবর্তন হয়েছে বলে বৃষ্টি হচ্ছে না। তাহলে বৃষ্টি না হওয়ার জন্য দায়িকে আবার ওই যে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে এর জন্যই বা দায়ী কে। আমার কথা হচ্ছে জলবায়ু পরির্বতনের জন্য যদি এখনই এমন হয় তাহলে আর তো দিন পড়েই আছে তখন কি হবে। এখনই তো আমার অনেক ভাই মাটির নিচ থেকে আর পানি তুলতে পারছে না বলে বন্ধ হয়ে আছে ওদের জীবনযাত্রা। তাহলে আরো কয়েক বছর পর আমাদের ভাগ্য কি হবে। কি হবো আমার সাথে যুক্ত হাজারো কৃষকদের। মাঝে মাঝে আমার খুব অনুশোচনা হয় যে আমার কারণেই খরা প্রবণ এ বরেন্দ্র অঞ্চলের পানির লেয়ার দিন দিন অনেক নিচে নেমে গিয়েছে। আমি আশংকা করি আমার কারণেই কি এ অঞ্চল মরুময়তার কবলে পড়ে যাবে? তাই এখন আমি সবাইকে বলি আমার বিকল্প খুজুন। ভূ-উপরিভাগের জলাধারগুলো সংষ্কার করুন।
আমি কত ঘটনার সাক্ষি
আমার জন্মের পর দেখতাম মাটির ড্রেন করে জমিতে পানি নিয়ে যাওয়া হতো। এত পানি নষ্ট হয় বলে ড্রেন পাঁকা করা হলো। তারপরও নাকি পানি নষ্ট হয় বলে মাটির নিচ দিয়ে পানি নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করা হলো। এক মাঠে আমার মতো একটি গভীর নলকূপ দিয়ে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা হলেও পানি কম উঠার কারষে আমার অনেক ভাইয়ের জন্য হলো একই মাঠে। আমার থেকে পানি না পেয়ে অনেক ছোট কৃষক শেষ সম্বল তার জমিটুকু বাগান ফসলের জন্য লিজ দিয়ে আজ অন্য পেশায় চলে গেল (এখানে আরো অন্য কারণ আছে)। অনেক কৃষক সারারাত ধরে অপেক্ষা করে আমার থেকে পানি না পেয়ে হতাশায় ভুগছে। আমি আরও দেখেছি কেউ কেউ আমার থেকে সারাবছর পানি তুলে ফসল চাষ করতে চায়। আবার আমি এমন মানুষও দেখেছি কম পানি লাগে বা পানি সেচ না দিলেও চলে এমন ফসল চাষ করার জন্য আলোচনা করে। আমি আরো দেখেছি এই অঞ্চলের কিছু মানুষ তার বাড়ির এক কিলোমিটার দূর থেকে এসে আমার থেকে খাওয়ার পানি নিয়ে যায়। আমি দেখেছি আমার থেকে পানি ভাগাভাগি ও আমার দখল নিয়ে মানুষের মাঝে হাতাহাতি মারামারি পর্যন্ত হচ্ছে।
উপসংহার
আমি শুনেছি এ অঞ্চলে আর নতুন করে আমার কোন ভাইয়ের জন্ম হবে না। শুনে খুব ভালো লেগেছিলো। কিন্তু আবার চিন্তা হচ্ছে আবার সৎভাই সাবমারসিবল পাম্পের অধিক ব্যবহার দেখে। এখন সবাই এটা বাড়িতে বসিয়ে আশে পাশের জমিগুলো সেচের ব্যবস্থা করছে। পুকুর, বিল, খাল, খাড়িগুলো রক্ষা করা হলে আমরা রক্ষা পাব। রক্ষা পাবে আমাদের বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষ। এ অঞ্চলের খাল, খাড়ি, পুকুর, দিঘী সংরক্ষণ করা না হলে বা পানি সংরক্ষণের স্থায়িত্বশীল কোন ব্যবস্থা নেওয়া না হলে এই যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনাবৃষ্টি শুরু হয়েছে তাতে করে কিভাবে রক্ষা হবে এ অঞ্চলের এবং এ অঞ্চলের মানুষের।