সুন্দরবন ও উপকূলীয় এলাকার জনজীবন
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা ঘুরে এসে নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়:
কর্মসূত্রে গত ৫-৮ জুন, ২০১৭ একটি কর্মশালায় উপকূলীয় এলাকায় যাওয়ার সুযোগ এলো। প্রথমবারের মতো আমি অত দূরের পথে একা রওয়ানা হয়েছিলাম। প্রথমে একটু ভয় কাজ করছিলো। কিন্তু আমার এতদিনের কর্মজীবনে প্রথমবারের মতো পাওয়া এই সুযোগ কিছুতেই ছাড়তে চাচ্ছিলাম না। আমার কাছে সবচে’ আকর্ষণের জায়গা ছিলো সুন্দরবন। এটি দেখার সুপ্ত বাসনা আমাকে অতদূর টেনে নিয়ে গেলো। আগে টিভিতে বা ছবিতে দেখতাম। দেখার সময় হা করে চেয়ে থাকতাম। সেই চেয়ে দেখার সাথে বাস্তবকে মিলিয়ে দেখেছি। অসম্ভব সুন্দর, ছবির মতন দেখতে। নিজেকে নিজে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
চুনা নদী, মালঞ্চ নদী দিয়ে আমাদের ট্রলার চলছিলো। নদীর দু’ধারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য সত্যিই অসাধারণ। ধানি ঘাস, কেওড়া, হেতাল, পশুর, গোলপাতাসহ আরো অনেক নাম না জানা গাছ দেখেছি। হরিণের প্রিয় খাদ্য কেওড়া গাছের পাতা ও ফল। এই গাছের পাতা ও ফল খেলে হরিণের শরীরের চর্বি কমে। আবার অনেক সময় ছাগলকেও এই পাতা খাওয়ানো হয়।
সুন্দরবন ভ্রমণের সময় নদীতে ছিল ভাটা। নদীর চরে কাঁকড়ার ছোট ছোট গর্ত, সেখান থেকে বের হয়ে আবার কোনো শব্দ শুনে টুপ করে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল। এই কাঁকড়া বড় হলে অর্থের যোগান দেয়। কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক অর্থ আয় করা যায়। নদীতেও পাওয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন নাম ও বৈশিষ্ট্যের মাছ। পারশে, ভেটকি, আমাদি আরো কত নামের মাছ আছে এই এলাকায়! জেনে অবাক হয়েছি যে, মাছের নামে সেখানকার অনেক গ্রামের নামকরণও করা হয়েছে।
নেত্রকোনা অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ, পেশা সব কিছু থেকেই সুন্দরবন অঞ্চলটি ভিন্ন। আমাদের এলাকায় নারীদের মাঠে গিয়ে কোনো কাজ করতে হয় না। কারণ এখানে মাঠে মাঠে ধান চাষ হয়। বসতভিটা ও তার পার্শ্ববর্তী জায়গায় সব্জী চাষ করা হয়। গৃহপালিত প্রাণি সম্পদও আছে। যেগুলো নেত্রকোনা অঞ্চলের নারীদের উপার্জনের উৎস। কিন্তু সেখানকার চিত্রটা অন্যরকম দেখেছি। কারণ উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ত পানির কারণে কোনো চাষাবাদ হয় না। বন ও নদীর সম্পদ আহরণ করেই তাদের জীবন চলে। যে কারণে নারীরা তাদের জীবন-জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছে। তারা নদীতে কাঁকড়া, মাছ ও মাছের পোনা ধরে। নদীতে ভাটার সময় শামুক ঝিনুক কুড়ায়। এগুলো বিক্রি করে সংসারের প্রয়োজন মেটায়। জেনেছি তারা যখন বনে যায় তখন রক্তের সম্পর্ক ছাড়া কোনো মানুষকে সাথে নেয় না। কারণ হলো তারা অন্য কাউকে বিশ্বাস করে না। বনকে তারা দেবতা হিসেবে পূজো করে।
নদীতে ঘুরে বেড়ানোর সময় দুটি জেলে দম্পতির সাথে কথা হলো। তাঁরা নৌকা করে এসে ছোট ছোট জাল দিয়ে সুন্দরবনের ভেতরে খাল থেকে মাছ ধরার চেষ্টা করছিলেন। এই মাছ ধরার জন্য তাঁদের জোয়ার ভাটার অপেক্ষা করতে হয়। ভাটার সময় জাল বিছানো আবার জোয়ারের সময় জাল তুলতে হয়। এক জেলে দম্পতি খালের এপার ওপার করে একটি মাছ ধরার জাল বিছিয়ে রেখেছে। রাত্রিতে যখন জোয়ার আসবে তখন তারা আবার সেখানে যাবে। জালটি তুলে আনার জন্য। জালে পাওয়া মাছ বিক্রি করে সংসারের চাহিদা পূরণ করবে। আর মাছ না পেলে হয়তো সেদিনের মতো হাঁড়িও চড়বেনা চুলাতে। ঝড়, বৃষ্টি মাথায় নিয়েই তাদের সেখানে যেতে হবে। প্রতি পদক্ষেপে আছে মৃত্যুর ছায়া। সেখানে গিয়ে বেঁচে ফিরতে পারবে কিনা সেই নিশ্চয়তা নেই। কারণ বাঘসহ কোনো ভয়ংকর প্রাণি বা বনদস্যুর আক্রমণে তাঁরা মারা যেতে পারে। গভীর রাত্রিতে আমরা যখন নিশ্চিন্তে ঘুমাই-তখন এই শ্রেণির মানুষেরা প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে নির্ঘুম রাত কাটায়।
বইতে পড়েছি বাংলাদেশের সবচে’ বড় ম্যানগ্রোভ অঞ্চল সুন্দরবন। শ্বাস মূলের মাধ্যমে গাছ তার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন গ্রহণ করে। অসংখ্য শ্বাসমূল আছে সেখানে। এই বন রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও অন্যান্য পশু পাখির জন্য ঘর। তারা সেখানে বাস করে।
জেলেদের সাথে কথে বলে জানতে পেরেছি- জঙ্গলের কোনো অংশে যখন বানর থাকে তখন সেই এলাকায় বাঘ থাকে না। বনজীবী বা জেলেদের জন্য বানর বন্ধুর মতো কাজ করে। বানরের সংকেত পেলে তাঁরা নিশ্চিন্ত হয়। তখন আপন মনে বনের সম্পদ আহরণ করতে পারে।
বাংলার মাটিতে সোনা ফলে। কিন্তু এই সোনা ফলাতে যে কত কাঠখড় পোড়াতে হয় তা বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের ব্যারাকের জীবনযাত্রা না দেখলে বুঝতে পারতাম না। লবণাক্ত মাটিতে অনেক পরিশ্রম করে তারা সব্জীর আবাদ করছে। নিজে খেয়ে বাড়তি সব্জী বিক্রি করে। নেত্রকোনা অঞ্চলের মাটি উর্বর। এখানে চাষের জন্য তেমন কষ্ট করতে হয়না। বীজ ফেলে রাখলেও চারা গজায়। নেত্রকোনা হাওড় বেষ্টিত হলেও বেশি পানি বা খরার সমস্যা এখানে নেই। লবণাক্ততা তো নয়ই। উপকূলীয় এলাকা শ্যামনগর বা সাতক্ষীরার পানিতে লবণ। যে কারণে মিষ্টি বা স্বাদুপানি পেতে তাদের দূর্ভোগ পোহাতে হয়। কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত হেঁটে পানি সংগ্রহ করে আনে নারীরা। তাছাড়া বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানির প্রয়োজন মেটায়। প্রকৃতির নির্মমতাকে উপেক্ষা করে এবং সেই নির্মম পরিবেশে খাপ খাইয়ে চলছে তাদের জীবন।
বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রতিবেশ সর্বত্র একই রকম নয়। নেত্রকোনা পলল ভূমির অঞ্চল এবং শ্যামনগর উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকা। উপকূলীয় এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, প্রাণবৈচিত্র্য মানুষকে বিমোহিত করে। কিন্তু মানুষের জীবনযাপন যে কতো কষ্টের সেটা হয়তো অনেকেই উপলব্ধি করতে পারে না বা করে না। বছরের পর বছর তারা প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে গিয়ে সংগ্রামী জীবন যাপন করে টিকে আছে এবং টিকিয়ে রাখছে প্রাণবৈচিত্র্য।