ডিমে তা দেওয়ার লোকায়ত প্রযুক্তি
হরিরমাপুর, মানিকগঞ্জ থেকে সত্যরঞ্জন সাহা
কোনো প্রযুক্তি বা উদ্ভাবন অতি সহজে বিস্তার লাভ করে যদি সেই প্রযুক্তির উপযোগিতা থাকে ও সহজ ব্যবহারযোগ্য হয়। ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটানোর অতি সাধারণ মাটির পাত্র নির্মাণ এমনই একটি সহজ প্রযুক্তি যা মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার খালপাড় বয়ড়া গ্রাম থেকে ২ বছরে বর্তমানে উপজেলার ৩ টি ইউনিয়নের ৮ টি গ্রামের মোট ১৬৯ টি পরিবার ব্যবহার করছেন।
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই উন্মুক্তভাবে হাঁসমুরগি পালন করা হয়। দেশি মুরগী পালনে খরচ কম, বাড়ির উচ্ছিষ্ট খাবার ও আশপাশের পোকামাকড় ধরে খায়। পাশাপাশি মুরগী পালনে তেমন খরচ করতে হয় না এবং ভাল দামে বিক্রয় করা সম্ভব তাই গ্রামের অধিকাংশ পরিবার মুরগি পালন করেন এবং নারীরাই সাধারণত হাঁস-মুরগী পালনে বড় ভূমিকা রাখেন। হাঁস-মুরগী পালন গ্রামীণ পরিবারে প্রাণীজ প্রোটিনের চাহিদা পুরণ করে তেমনি নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবল¤ী^ হতে সহায়তা করে।
বাংলাদেশে গ্রামীণ নারীদের মুরগি পালনে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন না হলেও কতিপয় কৌশল অবলম্বন করলে আরও লাভজনকভাব হাসমুরগী পালন সম্ভব। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মার্চ ২০১৪ সালে মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার খালপাড় বয়ড়া গ্রামের প্রান্তিক নারী ফজিরনের বাড়িতে ২৫ জন নারীর অংশগ্রহণে বারসিক মানিকগঞ্জ রিসোর্স সেন্টারের সহায়তায় ব্যবহারিক মাঠ প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয় যেখানে ডিমে তা দেওয়াকালীন মুরগীর খাবার, পরিচর্যা, ডিম নির্বাচন, যে পাত্রে বসে মুরগী ডিমে তা দেবে তা বানানো কৌশল হাতে কলমে শেখানো হয়। কেননা ডিমে তা দেওয়াকালীন সময়ে পরিমাণ মতো উষ্ণতা অতীব গুর”ত্বপূর্ণ বিষয়। সঠিক মাত্রায় উষ্ণতা না পেলে সব ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয় না। ডিম নষ্ট হয়ে যায়, অনেক সময় মুরগীও রোগাক্রান্ত বা দূর্বল হয়ে বাচ্চা রেখে মারা যায়। আবার কখনো কখনো মুরগী একটানা বেশি সময় বসে তা দিতে চায় না। এতে করে সঠিক উষ্ণতা পাওয়া ব্যহত হয়। ফলে কিছু ডিম থেকে বাচ্চা হলেও বাকি ডিম নষ্ট হয়। অনানুষ্ঠানিক এই ব্যবহারিক প্রশিক্ষণে নারীদের ডিমে তা দেওয়ার মাটির পাত্র বানানো কৌশল শেখানো হয় যেখানে খাবার ও পানির ব্যবস্থা থাকে ফলে মুরগী ডিম ছেড়ে বেশি বাইরে বের হয় না।
বয়ড়া ইউনিয়নের খালপাড় গ্রামের প্রান্তিক পরিবারের গৃহিনী ফজিরন বেগম বলেন, ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ শেষে ২০১৪ সালে মাটি দিয়ে এই পাত্রটি তৈরি করে ব্যবহার করি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ প্রশিক্ষকসহ এলাকার লোকজন ডিম ফুটানোর এই কৌশলটি দেখে প্রশংসা করেন। বর্তমানে শুধু এই গ্রামেরই ২৪ টি পরিবার মাটির তৈরি এই পাত্রটি তৈরি করে ডিম ফোটানোর কাজে ব্যবহার করছেন। এই পাত্রে ডিম বসালে ডিম নষ্ট হয় না এবং মুরগীও ভালো থাকে। একে অপরের দেখাদেখি বর্তমানে পাশ্ববর্তী আন্ধারমানিক, যাত্রাপুর, কর্মকারকান্দি, দড়িকান্দি, পাটগ্রামচর ও খড়িয়া গ্রামে ডিম ফোটানোর এই কৌশলটি ছড়িয়ে পড়েছে।
অপরদিকে পদ্মা তীরবর্তী লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের পাটগ্রাম চরের কৃষানী হাজেরা বেগম জানান, এলাকার মানুষ আগে মাটির পাত্র, ছাপনি, প্লাস্টিক পাত্র, টুপরী বা ঝাঁপি ডিম ফোটানোর কাজে ব্যবহার করত। এতে ২০টি ডিম বসালে ১৪-১৫টি বাচ্চা হয় বাকীগুলো নষ্ট হতো। এই পাত্রে ২০টি ডিম দিলে সেখান থেকে ১৮-১৯টি বাচ্চা হয়। মুরগী পালন বেশ লাভজনক বলে বর্তমানে গ্রামের নারীরা আগের চেয়ে বেশি মুরগী পালন করছেন। অন্যদিকে ডিম ফোটানোর এই পাত্রটির সহজ নির্মাণ কৌশল ও তৈরিতে তেমন কোনো খরচ না থাকায় যে সব পরিবার এটি ব্যবহার করছেন তাদের আতœীয় স্বজনরাও এটি তৈরি করে ব্যবহার করছেন বলে ক্রমশ এটির ব্যবহার বাড়ছে।
ডিম ফোটানোর লোকায়ত সহজ এই প্রযুক্তিটি বর্তমানে খালপাড় বয়ড়া গ্রামের ২৪ টি পরিবার, কর্মকারকান্দি গ্রামের ২২ টি পরিবার, আন্ধারমানিক গ্রামের ৩৫টি পরিবার, যাত্রাপুর গ্রামের ১৫ টি পরিবার, দড়িকান্দির ১২ টি পরিবার, বাহিরচরের ২২ টি পরিবার, পাটগ্রাম চরের ২১টি পরিবার ও খড়িয়া চরের ১৮ টি পরিবার ব্যবহার করছেন।