একজন সফল সবজি চাষী কাঞ্চন মিয়া

একজন সফল সবজি চাষী কাঞ্চন মিয়া

নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী

কেন্দুয়া উপজেলায় নগুয়া গ্রামের একজন কৃষক কাঞ্চন মিয়া (৩৫)। মা, ভাই-বোন ও এক ছেলে নিয়ে ৬ জনের সংসার। পিতার মৃত্যুর পর পরিবারের হাল ধরতে লেখাপড়া ছেড়ে ছোটবেলা থেকেই তিনি কৃষি কাজের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। কাঞ্চন মিয়ার পরিবারের মোট জমির পরিমাণ ২৩ কাঠা বা ২৩০ শতাংশ। এর মধ্যে বসতভিটা রয়েছে ৭০ শতাংশ, পুকুর ৮০ শতাংশ এবং আবাদী ধানী জমি ৮০ শতাংশ। ৮০ শতাংশ আবাদী জমি ও বসতভিটায় কাঞ্চন মিয়া বছরব্যাপী জাতের ধানসহ সবজি চাষ করেন। তার চাষকৃত ধানের মধ্যে বিরই, মুক্তা, আইজং, ঋতুপাইজাম, চিনিশাইল, কালোজিরা, ব্রি-২৮, ২৯, ৪৯ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মৌসুম অনুযায়ী তিনি এসব জাতের ধান চাষ করেন।

Kanchan

বৈচিত্র্যময় সবজি চাষে তিনি খুবই দক্ষ। বসতভিটায় তিনি বছরব্যাপী ডাটা, মূলা, বেগুন, পুইশাক, শীত লাউ, কচু লতি, মিষ্টিকুমড়া, সীম ইত্যাদি চাষ করেন। ধানসহ চাষকৃত সকল সবজি ও ফসলের বীজ তিনি নিজস্ব পদ্ধতিতে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে থাকেন। এছাড়াও তাঁর বসতভিটায় রয়েছে কাঁঠাল, নারিকেল, সুপারি, পেঁপে, আম, জাম, লেবু, কলা, পেয়ারা, হরতকিসহ স্থানীয় নানান জাতের ফলজ ও ঔষধি গাছ।

তিনি পুকুরে চাষ করেন রুই, কাতলা, মৃগেল, স্বরপুটি, কার্প, গ্রাসকার্প, পুটি, ঘইন্যা, কৈ, শিং, তেলাপিয়াসহ বৈচিত্র্যময় মাছ। কাঞ্চন মিয়া সবজি ও ধানসহ তার চাষকৃত সকল ধরনের ফসলে একমুঠো রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন না। নিজস্ব পালিত ৬টি গরুর গোবর দিয়েই তিনি সারাবছর রাসায়নিক সার ও কীটনাশকমুক্ত সবজি চাষ করেন। তিনি নিজ উদ্যোগে তিন বছর পূর্বে মাটিকাটা গ্রাম থেকে কেঁচো কমপোস্ট তৈরির পদ্ধতি শিখে এ যাবৎকাল পর্যন্ত কেঁচো সার, গোবর, জৈব বালাইনাশক তৈরি করে জমিতে ব্যবহার করছেন। উৎপাদিত সবজি, ডিম, দুধ, মুরগি বিক্রি করে তিনি ছোট দুই ভাই-বোনকে কলেজে অর্নাস পড়াচ্ছেন এবং দুই বোনকে বিয়ে দিয়েছেন।

একজন সফল চাষী হিসাবে এলাকায় কাঞ্চন মিয়ার বেশ সুনাম রয়েছে। গ্রামের অনেক কৃষক তার কাছ থেকে সবজি বীজ সংগ্রহ করে চাষাবাদ করেন। জমিতে সারের পরিবর্তে তিনি জৈব সার যেমন-গোবর, পচা আর্বজনা ও কেঁচো কম্পোস্ট ব্যবহার করেন। কীটনাশকের পরিবর্তে ছাই, নিমপাতা ও এগড়াপাতা দিয়ে বালাইনাশক তৈরি করে জমিতে ব্যবহার করেন। তিনি বছরে যে পরিমাণ
সবজি উৎপাদন করেন সেগুলো বিক্রির টাকায় ৫ জনের সংসারের চাহিদা মিটিয়ে আত্মীয়স্বজনকে ও পাড়া প্রতিবেশীদের সবজি ও সার দিয়ে সহযোগিতা করেন।

Kanchan-2

বীজ সংরক্ষণের জন্য তিনি ভালো এবং পুষ্ট ফল আলাদা করে বীজগুলো সংগ্রহ করে রৌদ্রে শুকানোর পর বোতলে ভরে মুখ বন্ধ করে রাখেন। পরবর্তী মৌসুমে যখন রোপণের সময় হয় তখন আরেকবার রৌদ্র দিয়ে ক্ষেতে রোপণ করেন। বছরের পর বছর ধরে তিনি নিজের সংরক্ষিত বীজ দিয়ে সবজি চাষ করে আসছেন। উৎপাদিত কেঁচো সার নিজের জমিতে ব্যবহারের পর উদ্বৃত্তটুকু ১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। তাঁর বাড়িতে প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক লোক আসে তার কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন ও সবজি চাষ পদ্ধতি জানার জন্য। তিনি সবাইকে সামর্থ অনুযায়ী বুদ্ধি ও পরামর্শ দেন এবং কেঁচো, সবজি ও ধানের বীজ দিয়ে সহযোগিতা করেন। ৮টি পাকা রিং এ তিনি কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন করছেন।

কৃষক কাঞ্চন মিয়া অল্প জমিতে রাসায়নিক সার ও বিষমুক্ত উপায়ে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করে যেমন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন, তেমনি নিজের প্রয়োজনীয় ফসলের বীজ সংরক্ষণ করে বাজার উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছেন। কাঞ্চন মিয়ার মতো সকল কৃষকদের উচিৎ বীজসহ সকল কৃষি উপকরণের জন্য বাজারের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজেরা বীজ সংরক্ষণ করা। আর এটি করা সম্ভব হলে শস্য বীজ ও সকল কৃষি উপকরণে কৃষকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা সেই দিনের প্রতীক্ষায়।

happy wheels 2

Comments