বিধবা শেফালী হাত পাতেন না কারও কাছে

চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
“কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠি। নামাজ কালাম পরে ৭টার মধ্যে রান্না-বান্নার কাজ শেষ করি। এর পর শুরুতে চলে যাই দক্ষিণ পাড়া। মানুষের ১৫ থেকে ১৬টি গাভী দোহন করি। গাভী দোহন করে দেওয়ার শর্তে আমার নিকট দুধ বিক্রি করেন তারা। দুধ দোহন করার সময় হাত টাস্যা আসে। একটানা তিন ঘণ্টা এ কাজ করতে হয় আমাকে। বালতি, কলসি দুধে ভরে যায়। চরপাড়া প্রাণের চিলিং সেন্টারে ৩০ থেকে ৩৫ লিটার দুধ বিক্রি করি। ফ্যাটের উপর দাম দেয়। ২৭ থেকে ৩০ টাকা লিটার দুধের দাম পাই। বাড়িতে এসে কিছু খেয়ে বাকি ২০ থেকে ২৫ লিটার দুধ বিক্রি করতে বেরিয়ে পরি চাটমোহরের উদ্দেশ্যে। বাসায় বাসায় দুধ রোজ দেওয়া আছে। তাদের বাড়িতে দুধ পৌছে দেই। ৫০ টাকা লিটার দাম দেয়। ২০ থেকে ২২ বাড়ি হেটে দুধ দিতে দিতে আড়াইটা বেজে যায়। বাড়ি ফিরতে প্রায় তিনটা। গোসল করে নামাজ কালাম পরে খাওয়া দাওয়া করতে করতে ৪টা থেকে সাড়ে চারটা বেজে যায়। কিছু সময় বিশ্রামের পর সাংসারিক অন্যান্য কাজ করতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। এরপর আবার মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ১৫ থেকে ১৬টি গাভী দোহন করি। প্রাণ কোম্পানিতে দুধ দিয়ে বাড়ি ফিরতে রাত প্রায় ৯টা বেজে যায়। এসময় আর রান্না বান্না করার মতো শক্তি ও ইচ্ছা থাকে না। একটা নাতনী থাকে আমার সাথে। সকালের ভাত খেয়ে শুয়ে পরে। রাতে কখনো রান্না করি কখনো করি না। তাই কখনো খাই কখনো না খেয়েই রাত কাটিয়ে দেই। সকাল হলেই ফের এক নিয়মে ছুটে চলি অন্যান্য দিনের মতোই। প্রতিদিন সকাল ও রাত মিলে ১শ’ থেকে ১শ’ ২০ লিটার দুধ দোহন করতে হয় আমাকে। গ্রামের পাশের পাড়াতে এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। আমার অসুখ বিসুখ হলে জামাই সাহায্য করে।” কয়েক দিন পূর্বে পাবনার চাটমোহর পৌর সদরের বালুচর খেলার মাঠের পূর্ব উত্তর কোনে চায়ের দোকানদার আশরাফুল এর বাড়িতে দুধ দেওয়ার সময় উপরোক্ত কথাগুলো বলেন চাটমোহরের গুনাইগাছা ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামের দুধ বিক্রেতা সংগ্রামী এক বিধবা নারী শেফালী খাতুন।

safali pic-1

বয়স কত আপনার জানতে চাইলে শেফালী বলেন, “বয়স কত জানি না তবে যে বছর হিড়িক হইছে সেই বছর আমার জন্ম। বাড়ি গুনাইগাছা ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামে। বাবার নাম ছিল কেরু সরকার। আমরা ৫ বোন। আমার বয়স যখন ১২ বছর তখন একই গ্রামের আবুল কাশেম নামক এক ব্যক্তির সাথে আমার বিয়ে হয়। উনি বয়ষ্ক মানুষ ছিলেন। সংসার কি আমি বুঝতাম না। এরপর দিন যাবার সাথে সাথে নিজেকে তার সাথে খাপ খাইয়ে নেই। উনি দুধ বিক্রি করতেন। আমি ও তার সাথে দুধ বিক্রি করতাম। হার্টের সমস্যায় প্রায় ১০ বছর পূর্বে তার মৃত্যু হয়। চার মেয়ে নিয়ে যেন সাগরে পরি আমি। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বামীর সেই পেশা আকড়ে ধরে এখনো দিনাতি পাত করছি। নিজে কষ্ট করে দিন রাত পরিশ্রম করে বড় মেয়ে শিউলীকে ১১ হাজার টাকা যৌতুক ও চার আনা সোনার গহনা দিয়ে রেলবাজার এলাকায় বিয়ে দিয়েছি। দ্বিতীয় মেয়ে মলিনাকে টেন পর্যন্ত পড়াই। এরপর প্রায় লাখ টাকা যৌতুক দিয়ে বাড়ির পাশ^বর্তী বিষি পাড়া এলাকায় বিয়ে দেই। ওর স্বামী হাল আবাদের কাম করে। তৃতীয় মেয়ে মোমেনা দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিল। ৪৫ হাজার টাকা যৌতুক দিয়ে তাকে চড়–ইকোলের পাশের পাঁচবাড়িয়া গ্রামে বিয়ে দেই। চতুর্থ মেয়ে চম্পা সিক্স পর্যন্ত পড়ে। ওকেও ৫৫ হাজার টাকা যৌতুক দিয়ে চড়–ইকোল এলাকায় বিয়ে দিয়েছি। চার মেয়েই শ^শুর বাড়ি থাকে। মাঝে মধ্যে আসে আমার এখানে। আমি একা তাই মলিনার মেয়ে জান্নাতি (আমার নাতনী) আমার কাছে থাকে। বাড়ি ঘর গুলো দ্যাখে।”

safali pic-5

শেফালীর নাতনী জান্নাতি স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছে। নানী ও নাতিনের সংসার। অধিক পরিশ্রম ও জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা শেফালী নিজে পরিশ্রম করে জীবন চালিয়ে নিচ্ছেন। বিয়ে দিয়েছেন চার মেয়েকে। তিনি হাত পাতেন না কারো কাছে এটাই তার আত্মতৃপ্তি। বাড়ি ছাড়া মাঠাল ১৫ কাঠা সম্পত্তি রয়েছে তার। মেয়েদের বিয়ের যৌতুকের টাকা দিতে সংসার চালাতে সব সময় অভাবের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে তাকে। ঋণ করেছেন। পরিশ্রম করে শোধ করেছেন ঋণ। কয়েক মাস পূর্বে শিলা বৃষ্টিতে পুরাতন টিনের ঘরের চালাটি ঝাঝড়া হয়ে গেলে মাথা গোজার ঠাই এ ঘরটি মেরামত করতে মাঠের ১৫ কাঠা সম্পত্তি ৫০ হাজার টাকায় অন্যের নিকট বন্ধক রাখেন এবং ফের একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহন করেন। গত বছর জমিতে রসুন লাগানোর সময় বেসরকারি সংস্থা থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। জমিটুকুও বেহাত হয়ে রয়েছে। দুধ বিক্রি করে লাভের টাকা থেকে ৭০ হাজার টাকা ঋণের বিপরীতে সপ্তাহে ১ হাজার ৭শ’ ৫০ টাকা কিস্তি দিতে হয় তাকে। এর পর খাওয়া পরা অসুখ বিসুখ আরো কত খরচ। এসবের হেসাব মেলাতে মেলাতে দিন কাটে রাত কাটে সংগ্রামী নারী বিধবা শেফালীর।

happy wheels 2

Comments