শেফালী বিবি যেভাবে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হলেন
সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল
নিজের সাহস, যোগ্যতা, আন্তঃনির্ভরশীলতা ও আত্মবিশ্বাস এবং কঠোর পরিশ্রম দ্বারা সমাজে নিজের শক্ত অবস্থান তৈরিসহ পারিবারিক ভাবে ভাগ্যের চাকা ঘুরালেন বনজীবী নারী শেফালী বিবি। অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মানল মানবেতর জীবন। তার দীর্ঘ সংগ্রাম ও কৌশলের মধ্য দিয়ে বনজীবীদের কাছে নারী নেত্রী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠলেন। নিজের ভাগ্য উন্নয়নে কঠোর পরিশ্রম করে পরিবারের হাল ধরেছেন। শেফালী বিবি নিজের প্রচেষ্টায় অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জন করে এলাকায় একটি রোল মডেল হয়েছেন।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিামাঞ্চলের সাতক্ষীরার শ্যামনগরের সুন্দরবনের কোলঘেঁষে বনজীবী অধ্যুষিত একটি ছোট গ্রাম দাঁতিনাখালী। মালঞ্চ নদীর পাড়ে এক টুকরো খাস জমির উপর শেফালী বিবির (৪২) পরিবারের বসবাস। বংশগত পেশাজীবী বনজীবী স্বামী ছবেদ আলী বছরের বারো মাস সুন্দরবন থেকে মোম, মধু, মাছ, কাঁকড়া, গোলপাতা প্রভৃতি সম্পদ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। একমাত্র মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে ২ ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে ছোট একটি সংসার। মুসলিম পরিবারের সদস্য হওয়াতে বাইরে বের হওয়া ও সাধারণ মানুষের সাথে চলাফেরার বিধি নিষেধ ছিল যথেষ্ট। ৬/৭ বছর আগের কথা, তখন নিজের আবদ্ধ জীবন তাকে ভাবিয়ে তোলে অনেকখানী, পরিবার ও সমাজের মানুষের অসহযোগিতা তাকে পিষে মারতে থাকে। মানুষ ও মানবতার জন্য কাজ করার প্রবল ইচ্ছাশক্তি চার দেয়ালের মধ্যে আটকা পড়ে যায়। কিন্তু অদম্য সাহসী শেফালী বেগম দমবার পাত্র নয়। পরিবার ও সমাজের সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা তাঁকে আরো সাহসী ও কৌশলী হতে শেখায়। ধীরে ধীরে বাইরের জগতে পদার্পণ ঘটতে থাকে তার। সুন্দরবনের স্থায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা ও সুন্দরবন নির্ভর জনগোষ্ঠীর জীবন জীবিকার মানোন্নয়নে কতিপয় প্রতিষ্ঠান দাঁতিনখালী গ্রামে কাজ শুরু করলে শেফালী বিবির এগিয়ে চলার পথ আরো বেশি মসৃণ হয়। বিভিন্ন মিটিং, আলোচনা ও সভা সেমিনারে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে গ্রামের মধ্যে হয়ে ওঠে একজন টিম লিডার। সময়ের পরিক্রমায় বনজীবীদের মধ্যে সক্রিয় নারী নেত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। একের পর এক উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করতে থাকেন। পর্যায়ক্রমে ভাগ্যের চাকা পরিবর্তন হয়ে যায়।
স্ত্রীর এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণকারী স্বামী ছবেদ আলী বলেন, “আমার বাড়িওয়ালা প্রথমদিকে ঘরের বাইরে যেত না, মানুষের সামনে যেত না। প্রথম পর্যায়ে বিমানে উঠে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ ছিল, কিন্তু যায়নি। সে এখন মানুষ ও মানবতার জন্য ভালো ভালো কাজ করতে পারছে এতে আমি খুশি, সংসারের চাকা ভালোভাবে ঘুরছে।”
৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করা শেফালী বিবি সুন্দরবন সুরক্ষা ও বনজীবিদের জীবনের মান উন্নয়নের জন্য এলাকার বন নির্ভর নারীদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন দাঁতিনাখালী বনজীবী নারী উন্নয়ন সংগঠন। শতাধিক নারী সদস্য নিয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার কাজটি করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। সংগঠনের সদস্যবৃন্দ কেওড়ার চকলেট, শুকনা আচার, জেলী (টক, ঝাল, মিষ্টি) জেলী (টক, মিষ্টি) ও কেওড়ার নোড়া এবং সুন্দরবনের সংগৃহিত মধু পরিশুদ্ধ করে বোয়ামজাত করছেন। মোম দিয়ে বিভিন্ন প্রকারের মোমবাতি, শোপিচ, সীট তৈরি করছে। পরিচ্ছন্ন পরিবেশে অর্গানিকভাবে প্রস্তুতকৃত এসব পণ্য আধুনিকতার ছোঁয়ায় বোয়াম/প্যাকেট জাত করে বিক্রয় করছেন। এসকল পণ্য বিক্রয়ের লভ্যাংশ বাঘ বিধবা ও বনজীবী নারীদের ভাগ্য উন্নয়নে ব্যয় করছে। সুন্দরবন ও বনজীবীদের নিয়ে কাজ করার শুরুতে ডাক পড়ে শেফালী বিবির।
আর্তমানবতার সেবায় নিবেদিত বনজীবী নেতা শেফালী বিবি তার আর্থিক সফলতা সম্পর্কে বলেন, “এমন একদিন ছিল যেমসয় মানুষ আমাদের চিনত না, মূল্যায়ন করত না। এখন আমাদের সেই দিন পাল্টে গেছে। সমাজে আমাদের একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মানুষের সাথে আমাদের সম্পর্ক স্থাপন হয়েছে। নারীরা সমাজে অবহেলার পাত্র নয়, তারা ও কাজ করে অর্থ উপার্জন করছে।”
শেফালী বিবি সুন্দরবন সুরক্ষা ও বনজীবিদের জীবনের মান উন্নয়নের জন্য এলাকার বননির্ভর নারীদের নিয়ে বনজীবী নারী উন্নয়ন সংগঠন গড়ে তুলে কাঠ বর্হিভুত বনজ সম্পদ দ্বারা কেওড়ার চকলেট, শুকনা আচার, জেলী (টক, ঝাল, মিষ্টি) জেলী (টক, মিষ্টি) ও কেওড়ার নোড়া এবং সুন্দরবনের সংগৃহিত মধু পরিশুদ্ধ করে বোয়ামজাত, মোম দিয়ে বিভিন্ন প্রকারের মোমবাতি, শোপিচ, সীট তৈরি, আরি, জুরি ও বাটিক বুটিকের কাজ করে, পরিচ্ছন্ন পরিবেশে অর্গানিকভাবে প্রস্তুতকৃত এসব পণ্য আধুনিকতার ছোঁয়ায় বোয়াম/প্যাকেট জাত করে বিক্রয় করে যে লভ্যাংশ পেয়েছেন, তার মাধ্যমে ২০ শতক জমি ক্রয় করেছেন। নিজের বসত ঘরটাকে মজবুত করেছেন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখাচ্ছেন। সংসারের অভাব ঘুচিয়েছেন।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের নারীরা সঠিক ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও সুউচ্চ দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সমাজের সকল ক্ষেত্রে পারদর্শিতা প্রদান করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের মানকে সমুজ্জল করতে পারবে। প্রান্তিক জনপদের বনজীবী নারী শেফালী বিবির মতো অনেক উদ্যোগী নারী রয়েছে, যাদের খুজে বের করে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করলে নারী-পুরুষ সমতা বিরাজ করবে একই সাথে দেশ ও জাতি এগিয়ে যাবে আরো একধাপ।