খাদ্য সার্বভৌমত্ব
এবিএম তৌহিদুল আলম, অর্পণা ঘাগ্রা ও সৈয়দ আলী বিশ্বাস
বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় খাদ্য কেবল খাবারের নিমিত্তে নয় বরং এখন এটি পরিণত হয়েছে বাজারের নিমিত্তে। তাই দেখা যায়, যেখানেই বাজার প্রাধান্য বিস্তার করছে, সেখানেই প্রান্তিক মানুষের খাদ্যে প্রবেশাধিকার কমেছে। আবার বাজারের প্রকৃতিও বদলে যাওয়ায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠির স্থানীয় সম্পদের উপর সমতাভিত্তিক অধিকার ও খাদ্যের উপর উপর নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ খর্ব হচ্ছে। খাদ্য আজ তাই এমন কিছু নয় যা শুধু উৎপাদন করলেই সব মিটে যায়। খাদ্য দখল করে নিচ্ছে তাই ব্যবসায়ী ও বহুজাতিক কোম্পানি। খাদ্যে স্থানীয় জনগণের প্রবেশাধিকার এখন কার্যত বাজারের উপর নির্ভরশীল আর আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির মারপ্যাঁচে বাঁধা।
খাদ্য শুধুই পণ্য নয়, খাদ্যের সাথে জড়িয়ে আছে প্রান্তিক উৎপাদনকারীর কৃষিজ চর্চা, মানুষের অভ্যাস, সংস্কৃতি ও অধিকার। খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রান্তিক কৃষক কেন্দ্রিয় ভূমিকা পালন করলেও বিশ্ব¦বাণিজ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন! ও বাণিজ্যনীতি কৃষকের অবস্থান ও ভূমিকাকে বদলে দিচ্ছে। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর খাদ্য সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট হচ্ছে, হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে প্রাণবৈচিত্র্য, কৃষি-ঐতিহ্য ও জনগণের জীবিকা। যার ফলে অধিকাংশ মানুষের খাদ্য সংকট ও জীবন-জীবিকায় সংকটের সম্ভাবনা দিন দিন বেড়ে চলেছে।
বর্তমানে খাদ্য উৎসের অধিকাংশই কৃষকের নিয়নত্রণের বাইরে। শহুরে মানুষের খাদ্যের বেশির ভাগই আসে কোনো না কোনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল খাদ্য চেইন থেকে যেখানে প্রান্তিক কৃষক শুধুই বাজারের চাহিদা পূরণের জন্য একজন উৎপাদনকারী শ্রমিক মাত্র। অতীতে আমাদের পূর্বপুরুষের খাবার ও খাদ্যের উৎস ছিল কৃষকের উৎপাদন যার অধিকাংশই সরবরাহ করতো প্রান্তিক কৃষক। কিন্তু বর্তমানে খাদ্যের উপর কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণের ফলে প্রান্তিক উৎপাদনকারী ও ভোক্তা ক্রমশ নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। খাদ্যসার্বভৌমত্ব পর্যাপ্ত পরিমাণে স্বাস্থ্যসম্মত, খাদ্যসংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত খাবারের উপর গুরুত্ব দেয়। অর্থাৎ নিজেদের খাদ্য, কৃষি, পশুপালন ব্যবস্থা, মৎস্য চাষ বা খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে কৃষকের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ও অধিকারই হচ্ছে খাদ্য সার্বভৌমত্ব। খাদ্যসার্বভৌমত্ব ছয়টি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত যার কেন্দ্রে থাকে মানুষের প্রয়োজন, খাদ্য উৎপাদনকারী প্রান্তিক কৃষকের স্বীকৃতি, স্থানিকভাবে খাদ্য উৎপাদন, প্রান্তিক উৎপাদনকারীর নিয়ন্ত্রন, চিরায়তজ্ঞান ও বাস্তুতন্ত্রের সম্পর্ক। রপ্তানির জন্য খাদ্য উৎপাদনে উন্নয়নশীল দেশের কৃষকের উপর মারাত্মক চাপ পড়ছে। বিশেষ করে উচ্চফলনশীল জাতের ফসল উৎপাদন করতে। কৃষকরা ক্রমাগতভাবে ধনী ও উন্নত দেশগুলোর বহুজাতিক কোম্পানির বীজ, সার ও কীটনাশকের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন এবং বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে এসব ক্রয় করতে। কারণ পেটেন্টকৃত এসব পণ্যে কোম্পানির রয়েছে একক কর্তৃত্ব। যার ফলে তারা ইচ্ছে মতো অনেক কিছুই করছে যা কৃষি ও কৃষকের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনছে এবং আমাদের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও খাদ্য নিরাপত্তাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টিকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে অধিক খাদ্য উৎপাদনে মনোনিবেশ করলেও খাদ্য সার্বভৌমত্বের বিষয়টি সরকারের কাছে গুরুত্বহীনই থেকে যাচ্ছে। ফলে খাদ্য উৎপাদন বাড়লেও উৎপাদনকারী কৃষকই থাকছেন প্রান্তিক। অন্যদিকে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করতে গিয়ে বহুজাতিক কোম্পানির কৃষি-রাসায়নিকের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় পরিবেশ-বাস্তুতন্ত্র ও জনস্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। কিন্তু খাদ্যসার্বভৌমত্ব অর্জন হলে যে খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্জন সম্ভব সে ধারণাটিও গুরুত্ব পাচ্ছে না।
খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য খাদ্যের উপর কর্পোরেটগুলোর নিয়ন্ত্রণ আর মুনাফা অর্জনকে গুরুত্ব না দিয়ে জনঅধিকার বিশেষ করে ভোক্তাদের অধিকার সবার আগে বিবেচনায় নেওয়া উচিত। কে কি ধরণের খাবার বাজার থেকে নেবে তা ভোক্তার রুচি ও এই বিষয়টির উপর কারো নিয়ন্ত্রণ থাকা অনুচিত। কারণ এটা তার অধিকার এবং ক্রেতার পছন্দই এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
জন-নেতৃত্বে উন্নয়ন পদ্ধতির মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে সহায়তা দানের মধ্যদিয়ে খাদ্যসার্বভৌমত্ব অর্জনের বিষয়টি গভীরভাবে জানা ও বোঝার জন্য বিগত ফেব্রুয়ারি ২৭ থেকে ২ মার্চ নেপালের ললিতপুরে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের ২৫ জন উন্নয়ন কর্মীর অংশগ্রহণে সপ্তাহব্যাপী এক কর্মশালা অনুষ্ঠিতা হয়। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা মিজারিও সহায়তায় ও এবং নেপালের স্থানীয় উন্নয়ন সংগঠন সোসাল ওয়ার্ক ইনস্টিটিউট এর আয়োজনে এই কর্মশালার সহায়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন ফুড সভরেনটি এলায়েন্স ভারতের সাগরী রামদাশ ও জার্মানির মারুজা সেলাস।