নেত্রকোনায় শতবাড়ি মডেল বিষয়ক অনলাইন সভা অনুষ্ঠিত
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
‘প্রতি ইঞ্চি মাটি, সোনার চেয়েও খাঁটি’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে গতকাল বারসিক নেত্রকোনা অঞ্চলের উদ্যোগে শতবাড়ি মডেল বিষয়ক অনলাইন কৃষক-কৃষক কর্ম অভিজ্ঞতা বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বারসিক নেত্রকোনা অঞ্চলের পরিচালক সৈয়দ আলী বিশ্বাস এর সঞ্চালনায় অনলাইন সভায় বারসিক নেত্রকোনা অঞ্চলের সকল স্টাফসহ নেত্রকোনা জেলার পাঁচটি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের শতবাড়ি মডেল পরিবারের ৩০ জন প্রতিনিধি অশগ্রহণ করে নিজ নিজ অভিজ্ঞতা পরস্পরের সাথে সহভাগিতা করেন।
সভায় আটপাড়া উপজেলার তেলিগাতী ইউনিয়নের যুব কৃষক মোজ্জালের হোসেন তার অভিজ্ঞতা সহভাগিতা করতে গিয়ে বলেন, ‘আমি ঢাকায় প্রায় পাঁচ বছর চাকরি করেছি। ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণ মহামারী আকার ধারণ করলে সবকিছু বন্ধ হয়ে গেলে এপ্রিল মাসে বাড়ি চলে আসি। তারপর সিদ্ধান্ত নিই আর ঢাকা না গিয়ে যে জমি আছে তাতে বছরব্যাপী সবজি চাষ করবো। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২০ সালেল অক্টোবর মাস থেকে জমিতে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ আরম্ভ করি। এক্ষেত্রে বারসিক’র কর্মীরা আমাকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি বীজ দিয়ে সহযোগিতা করেন। ২০২০ সালের অক্টোবর মাস থেকে মে ২০২১ পর্যন্ত সবজি বিক্রি করে সমূদয় খরচ বাদে আমি প্রায় দুই লাখ টাকার অধিক আয় করেছি। আমার বাড়িতে এখনও অনেক সবজি ফসল, ফল-মূল রয়েছে। আমি বাজার থেকে কোন ধরণের সবজি কিনে খাইনা। হাঁস, মূরগী, মাছ নিজেই চাষ করি। পরিবারের চাহিদা পূরণের পর বাজারে বিক্রি করতে পারি।’
সীমান্ত অঞ্চলের আদিবাসী কৃষক মথি ঘাগ্রা বলেন, ‘আমি সারাবছরই আমার ছোট বসতভিটায় বিভিন্ন ধরণের সবজি ও ফলের চাষ করি। সবজি চাষের পাশাপাশি হাঁস, মুরগি ও গরু পালন করি। নিজে বেশি পরিশ্রম করতে না পারায় বানিজ্যিকভাবে সবজি চাষ করতে পারিনা। তবে যে পরিমাণ সবজি সারা বছর চাষ করি তা পরিবারে খেয়ে, আত্মীয় ও প্রতিবেশিদের দিয়েও কিছু বাজারের বিক্রি করতে পারি। আমি ৫-৬টি স্থানীয় জাতের ধান চাষ করি। আমার চাষকৃত সবজিসহ সকল ফসলের বীজ নিজেই সংরক্ষণ করি ও অন্যদের সাথে বিনিময় করি। সম্পূর্ণ জৈব উপায়ে (সম্পূর্ণ রাসায়নিক সার ও কীটনাশকমুক্ত) চাষ করায় আমার চাষকৃত সবজি অনেক পুষ্টি সমৃদ্ধ ও নিরাপদ। এলাকার অনেক কৃষক-কৃষাণী আমার সবজি বাগান দেখে বীজ নিয়ে তাদের বাড়িতে চাষ করছে। আমার পরিবারের সদস্যদের পুষ্টির চাহিদা আমি নিজেই পূরণ করতে পারছি।’
সীমান্ত এলাকার অন্যান্য কৃষক-কৃষাণীদের মধ্যে কৃষক আব্দুল মোতালিব, আদিবাসী কৃষক নাহা হাজং, কৃষাণী সলিতা চিসিম, রেনুকা ¤্রং এবং সাবিনা রংদিও নিজ নিজ শতবাড়ি মডেলের অভিজ্ঞতা সহভাগিতা করেন। তাদের মতে, সীমান্ত এলাকায় বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ী ঢলে চাষকৃত সমস্ত ফসল নষ্ট হয়ে যায়। বারসিক’র পরামর্শে সীমান্ত এলাকার শতবাড়ি মডেল পরিবারগুলো সরাসরি মাটিতে সবজি চাষের পাশাপাশি বস্তা পদ্ধতিতে মরিচ, বেগুন, শিমসহ বিভিন্ন ধরণের সবজি চাষ করেছেন। বর্ষা মৌসুমে সীমান্ত এলাকায় সবজির অনেক আকাল হয়। শতবাড়ি মডেল করায় তারা বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করে খেতে পারছেন বলে কৃষকরা জানায়। মহামারী করোনাকালীন সংকটে সকলে বাড়িতে অবস্থান করায় সবজি চাষে তারা বেশি সময় দিতে পারছেন এবং উদ্বৃত্ত্ব সবজি বিক্রি করতে পারছেন বলে জানান।
সমতল এলাকার অন্যান্য শতবাড়ি মডেলের কৃষকদের মধ্যে আশুজিয়া গ্রামের কৃষক আবুল কালম, নগুয়া গ্রামের কৃষাণী রোকেয়া আক্তার, ফচিকা গ্রামের শিক্ষার্থী ও কৃষাণী দিপালী আক্তার, দরুন বালি গ্রামের কৃষক আবুল কালাম (কালাচাঁন), অরঙ্গবাদ গ্রামের শিক্ষার্থী ও যুব কৃষক আলীম শেখ, বানিয়াজানের কৃষাণী নাসরিন আক্তার ও নিজাম উদ্দিন, আইমার যুব কৃষক মোস্তাফিজুর রহমান দিনার, বাসাটির কৃষক ফজলুর রহমান, মঙ্গলসিদ্ধ গ্রামের আছমা আক্তার, আতকাপাড়ার স্কুল শিক্ষক ও কৃষাণী ইয়াসমিন আক্তার, দরুন হাসামপুরের কৃষাণী হোসনা আক্তার, জয়শি এর রোজী আক্তার, দক্ষিণ মদনের কৃষাণী পাপিয়া আক্তার, বিশ্বনাথপুরের পারভিন বেগম, মর্জিনা বেগম, গাছগড়িয়ার শিক্ষার্থী ও যুব কৃষক মাহামুদুল হাছান মামুন এবং কান্দাপাড়া গ্রামের কৃষাণী মহফুজা আক্তার নিজ নিজ বসতবাড়িকে শতবাড়ি মডেল সৃজনের অভিজ্ঞতা ও উপকারীতা সম্পর্কে পরস্পরের সাথে সহভাগিতা করেন।
শতবাড়ি মডেল বিষয়ক অনলাইন সভায় বারসিক নেত্রকোনার ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও রামেশ্বরপুরের আদর্শ কৃষক সায়েদ আহম্মদ খান বাচ্চু সভার সমাপনীতে নিজের শতবাড়ি মডেল সৃজনের অভিজ্ঞতা সকলের সাথে সহভাগিতা করতে গিয়ে বলেন, ‘আমি প্রতিবছর ৩০-৩৫টি বৈচিত্র্যময় জাতের সবজি চাষ করি, ৬-১০ জাতের ধান চাষ করি, পুকুরে হরেক রকমের মাছ, বসতভিটায় সবজির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরণের ফল ও ঔষধি গাছের চাষ করি, যা থেকে আমি পরিবারের সদস্যদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করেও বাজারে বিক্রি করে পরিবারের আয় বৃদ্ধি করতে পারছি।’ তিনি অংশগ্রহণকারী সকলকে বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ করে বৈচিত্র্যময় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে পুষ্টিস্তর উন্নয়নের মাধ্যমে মহামারী করোনা সংক্রমণ রোধের ভূমিকা রাখার আহবান জানান।
অংশগ্রহণকারীরা বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালীন সময়ে করোনা সংক্রমণ রোধে শতবাড়ি মডেলের মাধ্যমে বসতভিটার সামান্য জমিতে বৈচিত্র্যময় সবজি, ফল, গবাদী পশু-পাখি পালন ও মাছ চাষের মাধ্যমে জনগণের পুষ্টিরস্তর উন্নয়নে গৃহীত উদ্যোগের জন্য বারসিক’র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তারা বাড়িগুলোকে বৈচিত্র্যময় সবজি ও অন্যান্য ফসল চাষ এবং গবাদী পশু-পাখি পালন ও মাছ চাষের মাধ্যমে যাতে উন্নত শতবাড়ির মডেল হিসেবে গড়ে তুলে দৈনন্দিন পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে পারে সেজন্য বারসিক’র নিকট থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা কামনা করেন। অংশগ্রহণকারীরা প্রথমবারের মত তাদেরকে নিয়ে অনলাইনে এ ধরণের মতবিনিময় সভা আয়োজনের জন্য বারসিক’র প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
উল্লেখ্য, সভার শুরুতে সঞ্চালক সৈয়দ আলী বিশ্বাস অংশগ্রহণকারী শতবাড়ি মডেল পরিবারের সকল সদস্যদের শুভেচ্ছা জানিয়ে অনলাইন কৃষক-কৃষক অভিজ্ঞতা বিনিময় সভা আরম্ভ করেন। সঞ্চালক প্রথমে অনলাইন সভার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সকলকে অবহিত করেন। অতপর তিনি অংশগ্রহণকারী কৃষকদেরকে শতবাড়ি মডেল কর্মসূচির অভিজ্ঞতা পরস্পরের সাথে সহভাগিতার আহবান জানান।