সাতক্ষীরার পুষ্টি পরিস্থিতি-৩: পুষ্টি নিরাপত্তায় ”সম্ভাবনার ১০০০ দিবসে” গুরুত্বারোপ বিশেষজ্ঞদের
:: সাতক্ষীরা থেকে শেখ তানজির আহমেদ
বাবা-মায়ের অজ্ঞতার কারণে চরম অপুষ্টি নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছে দশ মাসের শিশু মাহবুব। শুধু মাহবুব নয়, সাতক্ষীরার প্রায় ৩০ শতাংশ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। সঠিকমাত্রায় পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে না পারায় কমানো যাচ্ছে না খর্বাকৃতির শিশুর সংখ্যাও। তাই পুষ্টি নিরাপত্তায় গর্ভধারণের পর থেকে জন্মের প্রথম ১ হাজার দিনে মা ও শিশুর প্রতি বিশেষ সেবা ও যত্নের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গর্ভধারণের পর থেকে শিশুর বয়স দুই বছর হওয়া পর্যন্ত সময়কে বলা হয় সম্ভাবনার ১০০০ দিন। এই সময়ে মা ও শিশুর সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করতে পারলে শিশু সঠিকভাবে শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি লাভ করার ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে যায়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এই সময়ে যদি শিশুর অপুষ্টি দেখা দেয় এবং বৃদ্ধি ব্যাহত হয় তাহলে পরবর্তীতে তা পুষিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। এজন্য মাতৃগর্ভে থাকাকালীন মায়ের সঠিক পুষ্টি খুবই জরুরী। কারণ শিশু তার সঠিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান মায়ের কাছ থেকেই পেয়ে থাকে। গর্ভাবস্থায় সঠিক পুষ্টি না পেলে জন্মের সময় কম ওজন এবং জন্মের পর শিশু অবস্থায় মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়। পৃথিবীব্যাপী শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ অপুষ্টি। এছাড়াও জীবনের প্রথম ১০০০ দিনের অপুষ্টি শিশুকে খর্বাকৃতি ও লিকলিকে রোগা করে দেয়।
কিন্তু দরিদ্রতা, অশিক্ষা ও কুসংস্কারের কারণে শিশু অপুষ্টির হার কমানো যাচ্ছে না।
ইউএন রিচের প্রাক্তন ন্যাশনাল ফ্যাসিলিটেটর এবং ইউএসএইডের জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ড. ইফতেখার রশীদ তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, শুধু সাতক্ষীরা নয়, সারাদেশে বেশ কিছু কুসংস্কার আছে। গর্ভধারণের পর গ্রামাঞ্চলে মায়েদের বেশি খেতে দেওয়া হয় না, পেটের মধ্যে বাচ্চা বড় হয়ে যাবে- এই কথা বলে। বেশি খেতে দিলে নাকি বাচ্চা হওয়ার সময় সমস্যা হয়। আবার অনেক জায়গায় শুনেছি, এমন কুসংস্কার আছে- গর্ভবতী মাকে কাতলা মাছ খেতে দেওয়া হয় না, বাচ্চার মাথা কাতলা মাছের মতো হয়ে যাবে বলে। হাঁসের মাংস খেতে দেওয়া হয় না- বাচ্চার গলা হাঁসের মতো হয়ে যাবে বলে। বাচ্চা হওয়ার পর মায়ের বুকের শাল দুধ না দিয়ে তাকে মধু ও চিনি মিশ্রিত পানি খাওয়ানো হয়। এছাড়া অজ্ঞতার কারণে অনেকে ৬ মাসের আগেই বুকের দুধের সাথে সাথে বিস্কুটসহ অন্যান্য খাবার দেয় আবার অনেকে ৭/৮ মাসে গিয়ে বাড়তি খাবার দেয়। এসব কারণে মা ও শিশু অপুষ্টির শিকার হয়।
তিনি বলেন, গর্ভধারণের পর থেকে শিশুর জীবনের প্রথম ১০০০ দিবসে সঠিক পুষ্টি শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী করে এবং বিভিন্ন রোগ থেকে বাঁচায়। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে সেই শিশুর শিক্ষা গ্রহণের ক্ষমতা বেশি হয় এবং প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পরে অন্যান্যদের তুলনায় বেশি কর্মক্ষম হয়। একজন সুস্থ সবল ব্যক্তি হওয়ায় তার আয় করার ক্ষমতা বেশি হয়, তাই পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিতে অবদান রাখতে পারে। এজন্য গর্ভাবস্থায় মায়েদের প্রতি বিশেষ যতœ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট ইনিশিয়েটিভের কান্ট্রি ডিরেক্টর ডা. এসএম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সাধারণত আমরা ধরে নেই, বাচ্চা মায়ের পেটে ২৭০ দিন থাকে। খুবই স্বাভাবিক যে এই সময়টাতে যদি মা ঠিকমত পুষ্টি গ্রহণ করতে না পারে, তবে বাচ্চাও পুষ্টি পাবে না। ফলশ্রুতিতে বাচ্চা অপুষ্টিজনিত জটিলতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করবে। এই জন্য গর্ভধারণের পর মাকে অবশ্যই বাড়তি যত্ন নিতে হবে। বাচ্চা হলে প্রথম ৬ মাস শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়াতে হবে এবং তারপর বুকের দুধের সাথে বাড়িতে তৈরি অন্যান্য খাবার খাওয়াতে হবে।
তিনি বলেন, আমি মনে করি, এই সময়টা ভবনের ফাউন্ডেশনের মতো। ফাউন্ডেশন ভাল হলে তারা পরবর্তী জীবনে সুস্থ, কর্মক্ষম হয়ে বেড়ে উঠবে।
সাতক্ষীরা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. লিপিকা বিশ্বাস বলেন, গর্ভধারণের পর অনাগত শিশুর সুস্থতা ও সঠিক বিকাশের জন্য মায়েদের পরিমিত খাবার ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদেরকে সকল প্রকার ভারী কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে। নিয়মিত চেকআপ ও ওজন পরিমাপের ব্যবস্থা করতে হবে। কেবলমাত্র একজন সুস্থ সবল মাই পারে সুস্থ সন্তান প্রসব করতে। অপুষ্টির প্রাথমিক স্টেপ এভাবেই প্রতিরোধ করা যায়। আর তা না হলে শিশু অপুষ্টি নিয়ে জন্ম গ্রহণ করতে পারে। এতে মা ও শিশু উভয়েই ক্ষতির শিকার হয়।
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ শামসুর রহমান বলেন, জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শিশুকে শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। কারণ শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি উপাদান বুকের দুধেই যথেষ্ট পরিমানে আছে। ছয় মাস পর থেকে বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি থাবার দিতে হবে। এভাবেই প্রথম ১০০০ দিবস পর্যন্ত শিশুকে বিশেষ পরিচর্চা করতে হবে। কেবলমাত্র তাতেই শিশুর সুষ্ঠু বিকাশ সম্ভব। অনেকেই মনে করে বাজারে যেসব দামি দামি ফল পাওয়া যায় তাতে বেশি পুষ্টি থাকে। কিন্তু এই ধারণ ভুল। আমরা বাড়িতেই যেসব খাদ্য খাই, সেগুলোই পরিমান মত খেতে পারলে সঠিক মাত্রায় পুষ্টি পাওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, একই রকম খাবার প্রতিবার না দিয়ে বিভিন্ন খাবার মিশিয়ে দিতে হবে। যাতে সব ধরনের পুষ্টি উপাদান পেতে পারে। একই সাথে গর্ভধারণের পরে মায়ের পুষ্টিও নিশ্চিত করতে হবে।