পিঠা বৈচিত্র্য, সংস্কৃতি ও সম্পর্ক
নেত্রকোনা থেকে অহিদুর রহমান:
গ্রামীণ মানুষের জীবনে পিঠা হচ্ছে আনন্দ, একটি উৎসব, একটি পার্বণ। শীত আসে আর গ্রামের নারীদের মনে জাগে পিঠা বানানোর বাসনা। নবান্নের পরপরই ঘরেঘরে চলে পিঠার নাড়াচড়া। জামাই আসে, নতুন জামাই, বেয়াই আসে, বেয়ান আসে, তালই আসে, মা ঐ আসে, ছেলে আসে, মেয়ে আসে- সবার পাতে পিঠা পড়তেই হবে; পিঠার পর্ব থাকবেই। পৌষ আসে, বৈশাখ আসে, ভাদ্র আসে, আর গ্রামের নারীদের হাতের স্পর্শে যেন প্রাণ পায় নানা রঙবেরঙ এর পিঠারা।
পিঠা শুধুই আমাদের একটি মুখরোচক খাদ্য নয়; আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সম্পর্কের এক আবহমান মেলবন্ধন। আমাদের সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকেও প্রতিনিধিত্ব করে এই পিঠারা। পিঠাকে রক্ষা করতে হলে ধানকে রক্ষা করতে হবে, নারকেল, ফল, সবজি, আখ, সরিষা ফুলকেও রক্ষা করতে হবে। কারণ পিঠার জন্য আলাদা ধান থাকে- যেমন থাকে মুড়ির জন্য আলাদা ধান, চিড়ার ধান থাকে। ধানের সাথে সাথে লাগে পিঠার জন্য তেল, চিনি সবজি আরো কত জ্ঞান- বিশ্বাস। তাই প্রকৃতি এবং সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্যতা যত কমবে- পিঠার বৈচিত্র্যতাও কমবে।
নবান্নের আগমনের সাথে সাথে, শীতের আগমনের সাথে সাথে পিঠা বানানো ও খাওয়ার ধুম পড়ে যায় গ্রামে গ্রামে প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে। আত্মীয়-স্বজনের এই সময়ে পরস্পরের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। এতে করে মানুষে মানুষে, আত্মীয় অনাত্মীয়ে সম্পর্ক বাড়ে। এক বাড়িতে পিঠা তৈরি হলে পাশের বাড়ির লোকজনকে দাওয়াত করে, নিয়ে যায়, আদান-প্রদান হয়। গ্রাম বাংলার এসব সংস্কৃতি, আদান-প্রদান দিনদিন কমে যাচ্ছে। ফলে মানুষের মধ্যে সম্পর্ক ও বিশ্বাস কমে যাচ্ছে। এগুলো আমাদের গ্রামবাংলার সংস্কৃতি, সম্পর্ক এবং বন্ধনের প্রক্রিয়া। তাই আমাদের প্রয়োজনেই পিঠা বৈচিত্র্যতাকে ধরে রাখতে হবে। পিঠা সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে হবে। তবেই ন্যায্য সমাজ, শান্তির পরিবেশ, সংহতির বন্ধন গড়ে উঠবে।
এখনো নেত্রকোনা অঞ্চলে শত প্রকার পিঠা তৈরি হয়। প্রদর্শন করা হয় বিভিন্ন মেলায় ও উৎসবে। গ্রামের নারীরা তাদের হাতের নৈপুণ্য দিয়ে নানা জাতের, নানান বর্ণের পিঠা তৈরি করেন। কত বাহারি নামের পিঠাই না তৈরি করে গ্রামীণ নারীরা। নেত্রকোনা অঞ্চলে কিছু তৈরিকৃত পিঠার নাম হল:
ধামা পিঠা, পুলি পিঠা, শাহী পিঠা, মেরা পিঠা, কেক পিঠা, পাটিসাপটা, গাজরের পাটিসাপটা, নারিকেলের পিঠা, মালপোয়া, চ্যাপা পিঠা, ফুলপিঠা, দুধপুলি, তালের পিঠা, কলার পিঠা, তালের পাটিসাপটা, সবজীপিঠা, ভাপা, সাচের পিঠা, ঝালপিঠা, মসল্লা পিঠা, নকশীপিঠা, পুরাপিঠা, চিতুই পিঠা, দুধচিতই, কড়কইড়া, সিংগারা পিঠা, সেমাই পিঠা, পাপড় পিঠা, আউরাকেশী, শিরকাটা, শিলপিঠা, ছাচ পিঠা, ছিটকাপিঠা, চুটকিপিঠা, চাদ পাকন, সুন্দরী পাকন, পাতাপিঠা, পোয়াপিঠা, মালাইপিঠা, মুঠিপিঠা, আন্দশা, কুলশি, কাটাপিঠা, খেজুরের পিঠা, ক্ষীরকুুলি, গোকুলপিঠা, গোলাপ ফুলপিঠা, লবঙ্গলতিকা, রসফুল পিঠা, জামদানি পিঠা, হাড়িপিঠা, ঝাল পোয়াপিঠা, ঝুরি পিঠা, ঝিনুক পিঠা, সূর্যমূখী পিঠা, নারকেলের ভাজাপুলি, নারকেলের সিদ্ধপুলি, নারকেল জেলাফি, তেজপাতাপিঠা, তেলের পিঠা, সন্দেশপিঠা, দুধরাজ, ফুলঝুরি পিঠা, বিনিয়ানা পিঠা, চেড়ার মোয়া, সরলপিঠা, কালাইপিঠা, জামাই ভুলানো পিঠা, মিষ্টিপুুলি, কমলা পিঠা, ডিমপিঠা, মনমহিনিপিঠা, পুতুল পিঠা, বিস্কুটপিঠা, চমচমপিঠা, কড়িপিঠা, প্রভৃতি।
গ্রামীণ নারীদের বানানো এসব পিঠায় নেই কোন রাসায়নিক উপাদান। বিশুদ্ধ, বিষমুক্ত এই পিঠা এখনও গ্রামের নারীদের মাঝে আনন্দের খোরাক যোগায়। রাতভর জেগে থেকে নারীরা পিঠা বানিয়ে আনন্দ পায়। জানিয়ে দেয় তাদের পিঠা তৈরীর ঐতিহ্য কত বৈচিত্রপূর্ণ ও ঐহিত্য।