বরেন্দ্র এলাকার সুগন্ধি ধান ‘রাঁধুনী পাগল’ এবার ভারতের জিআই ট্যাগের কবলে
বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে শহিদুল ইসলাম
“রাঁধুনি পাগল, কালিজিরা, বাদশাভোগ, গোবিন্দিভোগসহ নানা ধরনের স্থানীয় ধান আমার বাবা-দাদারা ও চাষ করতেন। নানা সংকটের মধ্যে দিয়ে আমিও বিলুপ্ত প্রায় এই ধানজাতগুলো চাষাবাদ ও সংরক্ষণ করে চলেছি। এর জন্যে সরকার আমাকে ২০১৩ সালে জাতীয় পরিবেশ পদকে ভূষিত করেছেন। এই ধানজাতগুলো আমাদের দেশের সম্পদ। এগুলো সুরক্ষা করা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।” আক্ষেপের সাথে কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহীর তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামের লুপ্ত ধানের সংরক্ষক সত্তোর্ধ কৃষক মো. ইউসুফ আলী মোল্লা।
বরেন্দ্র এলাকায় কর্মঅভিজ্ঞতা, কর্মএলাকায় প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ এবং প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন তথ্য পর্যবেক্ষণে জানা যায়, বাংলার বিশাল-বিপুল ধান ভান্ডার থেকে দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশীয় ধানবৈচিত্র্য। বর্তমানে সুগন্ধি চালের কদর দেশে এবং দেশের বাইরে বেড়ে যাওয়ায় এখন চলছে সুগন্ধি ধানজাত নিয়ে নানা ধরনের দখলবাণিজ্য। প্রতিটি দেশ তাই পণ্যের স্বত্ত্ব (প্যাটেন্ট) ও ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য বা পণ্যের জিআই নিতে তোড়জোর শুরু করে দিয়েছে। এর ফলে আমাদের তৃণমূল প্রান্তিক মানুষের উৎপাদন কৌশল এবং চিরায়ত পণ্যের অধিকারগুলোও সংকটে পড়ছে। প্রান্তিক মানুষ যারা তাদের অভিজ্ঞাতার মধ্যে দিয়ে সেই পণ্য সমৃদ্ধ করেছেন, বহুদিনের পরিচর্যায় চাষাবাদের উপযোগি করে তুলেছেন সেই সব পণ্যের মালিকরা জিআই এর নামে কেড়ে নিয়ে বাণিজ্যিক দুনিয়ায় এর স্বত্ত্ব পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে পণ্যের ভৌগলিক নির্দেশক বা জিআই বিষয়টি এখন বহুলভাবে প্রচারণা পায়নি। তাই এর ভয়াবহতা সম্পর্কে আমরা তেমন অবহিত নয়। প্রতিটি মানুষ তার জীবিকার জন্যে সকল ধরনের পণ্য উৎপাদন করবে, প্রয়োজনে বিনিময় ও ক্রয় বিক্রয় করবে। অর্থাৎ পণ্যের মধ্যে সকলের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে এটাই চিরন্তন সত্য। যুগ যুগ ধরে মানুষ তার আশপাশের প্রকৃতি থেকে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই এসব জ্ঞান এবং সম্পদের সৃষ্টি করে ব্যবহার উপযোগী করে তুলেছেন। কিন্তু ইদানিংকালে বাণিজ্যিক দুনিয়ায় পণ্যের দখলদারিত্ব চলছে মুলত ব্যবসায়িক কারণেই। জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেটর) সনদ তেমন একটি বিষয় যা সনদ উৎপাদকদের পণ্যের স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দেয় এবং অন্য দেশের সমজাতীয় পণ্য থেকে তাদের পণ্য আলাদাভাবে চেনা যায়। এর ফলে এই পণ্যের আলাদা ভাবমূর্তি তৈরি হয়। বিশ্ববাজারে উৎপাদনকারীরা পণ্যের অধিক দাম পান। ট্রেডমার্কের সঙ্গে এর পার্থক্য হলো ট্রেডমার্ক কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিতে পারেন কিন্তু ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) সনদের অধিকারী একটি দেশ পণ্যটি প্যাটেন্ট করার ক্ষমতা অর্জন করে থাকে এবং ঐ পণ্যটি সেই দেশেরই পণ্য হিসেবে বিশ্ববাজারে পরিচিতি পাবে। এতে সেই স্থানীয় উৎপাদকরা ভালো দাম পাবেন এবং পণ্যটি নিয়ে গবেষণা করতে পারবেন। মোট কথা জিআই পণ্য কোনও দেশ আমদানি বা রপ্তানি করতে চাইলে উৎপাদনকারী মালিক দেশকে একটি নির্ধারিত হারে রয়েলটি দিতে হবে। তাই আমাদের কোনো পণ্য যদি অন্য দেশের জিই হিসাবে লিপিবদ্ধ হয় তাহলে সেই পণ্য নিয়ে আমরা কোন গবেষণা বা সেই পণ্য বিশ্ববাজারে বিক্রিও করাও যাবে না। সব থেকে বড় কথা হলো সেই পণ্যের উপর আমাদের কোন অধিকারই থাকবে না। বাংলাদেশ রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে জানা যায়, বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে শর্তসাপেক্ষে সুগন্ধিচাল রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছিলো। সেসময় বেশকিছু দেশীয় কোম্পানি সুগন্ধি চাল রপ্তানিও করেছিলো। যদিও বেশিরভাগ সময়ে দেখা যায় এই সুগন্ধি চাল উৎপাদনকারী কৃষক তার ন্যায্য মূল্য পায়নি। বেশিরভাগ সময় দেখা যায় মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরাই বেশি লাভ করে থাকে। এক্ষেত্রে উৎপাদক কৃষক এবং ভোক্তা উভয়ই ঠকে থাকেন।
সুগন্ধী চালের মধ্যে দেশীয় জাতগুলোরই কদর বেশি। তাই দেশী জাতগুলো সুরক্ষায় আমাদের জাতীয়ভাবে উদ্যোগ নেয়া দরকার। একই সাথে কৃষকের অধিকারের দিকগুলোও দেখার সময় হয়েছে। একই সাথে আঞ্চলিকভাবে ঐতিহ্যবাহী ধানজাতগুলো সুরক্ষা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ অঞ্চলভেদে এইসব জাত সেই অঞ্চলের আবহাওয়া এবং পরিবেশ সহনশীল। আবার সেই অঞ্চল ছাড়া ঐ জাতগুলোর ভালো ফলাফলও পাওয়া যায় না। এটা অনেকটা প্রমাণিত হয়েছে যে, দিনাজপুর অঞ্চলের কাটারিভোগ ধান অন্য অঞ্চলে চাষ করলে সুগন্ধ কমে যায়। তেমনি রাজশাহী অঞ্চলের রাঁধুনিপাগল, বাদশাভোগ, চিনিগুড়া, উকনী মধু ও দাদখানিসহ কিছু ধানজাত এই উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চলেই বেশি ভালো ফলাফল দেয়।
বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চল অত্যন্ত আদি এবং বিশেষ ভৌগোলিক বৈশিষ্ট সম্পন্ন একটি অঞ্চল। আদিযুগ থেকে এই অঞ্চলটির মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। কৃষিই এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান জীবন জীবিকা। তাই সঙ্গত কারণেই এই অঞ্চলের কৃষকদের নানা ঐহিত্যবাহী জাতের সাথে পরিচিতি এবং হাজার বছর থেকে তারা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ধানের জাত চাষ করে আসছেন। প্রবীণ কৃষক এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য ও প্রতিবেদনের মাধ্যমেও সেইসব ধান জাতের কথা জানা যায়। এ এলাকার লুপ্তধানের সংরক্ষক মো. ইউসুফ আলী মোল্লা শত বছরের বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক ঐতিহ্যবাহী ধানজাত সুরক্ষা করে আসছেন। বাবার এবং দাদার হাতে চাষ হওয়া ‘রাঁধুনীপাগল’ এর মতো বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক ধরনের সুগন্ধী ধানজাত বছরের পর বছর জীবন্ত রেখে চলেছেন। এমনকি দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকেও তিনি বিভিন্ন দেশীয় জাতগুলো সংগ্রহ করে থাকেন। তিনি কালিজিরা, চিনিগুঁড়া, চিনিআতপ, বাদশাভোগ, রাঁধুনি পাগল, বাঁশফুল, জটাবাঁশফুল, বিন্নাফুল, সাদাআতপ, রঘুশাইল, লতিফশাইল, দাদকানি, কাইশ্যা বিন্নি, উকনীমধু, নাবিপারিজাত, ধনিয়া, মগি, মালশিরা ইত্যাদি ধানের জাতগুলোর চাষ করে থাকেন। উদ্বেগের বিষয় হলো, সম্প্রতি পশ্চিবঙ্গ সরকার বিভিন্ন পণ্যের জিআই ট্যাগের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তারা রাঁধুনি পাগল ও কালিজিরা ধানের জিআই ট্যাগের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে ভারত গোবিন্দভোগ ও তুলাইপাঞ্জি ধানের জিআই স্বীকৃতি নিয়েছেন। একই সাথে অন্যান্য বিখ্যাত সুগন্ধি ধানজাতগুলোরও তালিকা তৈরি করে সেগুলোর জিআই সনদের জন্যে জোর প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন।
এই প্রেক্ষিতে বাংলার ঐতিহ্যবাহী ধানজাতগুলোর জিআই করা আজ অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। রাজশাহী তথা বরেন্দ্র অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী সুগন্ধি চাল ‘রাধুনী পাগল’ রক্ষায় সরকার জামদানি ও ইলিশের মতো জোর উদ্যোগ গ্রহণ করবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
তথ্যসূত্র:
১.ভাতপাতের সুরভি রক্ষাতেও হাতিয়ার জিআই, আনন্দ বাজার পত্রিকায় ২৬ নভেম্বর, ২০১৭http://www.anandabazar.com/state/government-taking-initiatives-to-save-aromatic-rice-in-state-1.713473
২. After Rosogolla, Bengal plans GI tags for Kalonunia, Randhunipagal rice, The Economic Times 08 wW‡m¤^i, 2017
https://economictimes.indiatimes.com/news/economy/agriculture/after-rosogolla-bengal-plans-gi-tags-for-kalonunia-randhunipagal- rice/articleshow/61980674.cms?from=mdr ,
- Bengal plans GI tag for Kalonunia and Randhunipagal rice http://aitcofficial.org/aitc/bengal-plans-gi-tag-for-kalonunia-and-randhunipagal-rice/?0&cat_id=1