আমাদের সেবায় প্রকৃতি ও বন
সিলভানুস লামিন
ভূমিকা
বলা হয়ে থাকে, সমৃদ্ধ বন ও প্রকৃতির মাঝেই নিহিত রয়েছে যেকোন দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং মানুষের কল্যাণ। একটু লক্ষ্য করলেই আমরা এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পেতে পারি। প্রকৃতি ও সমৃদ্ধ বনাঞ্চল কীভাবে প্রতিনিয়তই আমাদের সেবা করে যাচ্ছে? এর উত্তর হলো: আমরা যে খাদ্য খাই, যে পোশাক পড়ি, যেসব ঔষুধ খাই কিংবা যে আসবাবপত্র ব্যবহার করি এরকমই প্রায় ৫ হাজার পণ্যসামগ্রীর মূল যোগানদার হচ্ছে এই বন। শুধু কি তাই? বন মাটির ক্ষয়রোধ করে, জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে মানুষ ও সম্পদ রক্ষা করে, বিশুদ্ধ পানি প্রদান করে। বন ও প্রকৃতি হচ্ছে নানা ধরনের পশু-পাখি এবং উদ্ভিদকনার নিরাপদ আবাসস্থল।
বন ও প্রকৃতির সেবাসমূহ এবং সবুজ অর্থনীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এর অবদান
বিশ্বের মানুষের কল্যাণ আনায়নে প্রকৃতি ও বন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আফ্রিকা বিশেষ করে পশ্চিম ও দক্ষিণ আফ্রিকা অঞ্চলের মানুষের মোট পারিবারিক বার্ষিক আয়ে প্রকৃতি ও বনের অবদান ২২ শতাংশ। মানুষ কোন কারণে শস্য-ফসল উৎপাদন আশানুরূপভাবে করতে না পারলে বন ও প্রকৃতি থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে তারা সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে। বন বিশেষজ্ঞদের গবেষণা মতে, যেসব পরিবার প্রকৃতি ও বন এবং বনাঞ্চলের আশেপাশে বসবাস করে তারা তাদের মোট বার্ষিক পারিবারিক আয়ের একপঞ্চমাংশ থেকে একচর্তুথাংশ পর্যন্ত বন ও প্রকৃতি থেকে লাভ করে। বিশ্বের অনেক দেশে কাঠবর্হিভূত বিভিন্ন সম্পদ তথা খাদ্য, উদ্ভিজ পণ্য, ঔষুধ, সুগন্ধি এবং কাঁচামাল সে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বন ও প্রকৃতি মানুষের কর্মসংস্থান তৈরিতে ভূমিকা রাখে। ২০১১ সালের একটি তথ্য থেকে জানা গেছে, বিশ্বের প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বনভিত্তিক বিভিন্ন কর্মসংস্থানের সাথে জড়িত। এর মধ্যে কাঠ, কাগজের মণ্ড তৈরিতে এবং কাগজ প্রক্রিয়াকরণের সাথে বিশ্বে ১৪ মিলিয়ন মানুষ জড়িত, আসবাবপত্র শিল্পের সাথে ৪ মিলিয়ন, ক্ষুদ্র বন উদ্যোক্তা হিসেবে ৩০-১৪০ মিলিয়ন, কৃষিবনায়নের সাথে ৭১-৫৮৮ মিলিয়ন এবং বন ও প্রকৃতির ওপর সরাসরিভাবে নির্ভরশীল আদিবাসী মানুষের সংখ্যা ৫০০ মিলিয়ন থেকে ১.২ বিলিয়ন পর্যন্ত। ২০১৭ সালে এসে নিশ্চয়ই এ তথ্যে আরও পরিবর্তন (বৃদ্ধি বা হ্রাস) হতে পারে!
প্রকৃতপক্ষে, বন ও প্রকৃতি মানুষের জন্য পুষ্টি প্রদান করে, তাদের জ্বালানি চাহিদা পূরণ করে এবং বিভিন্ন আপদ-দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে। বনজ ফল, বাদাম, মধু ও মাশরুম পুষ্টির উৎস। অন্যদিকে বন সুপেয় পানি সংরক্ষণ ও বিশুদ্ধ করে, পানি প্রবাহকে রক্ষা করে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রশমন করে এবং মাটির ক্ষয়রোধ করে। এছাড়া বিশ্বের প্রায় ২ বিলিয়ন মানুষ রান্নার জন্য, তাপের জন্য এবং খাদ্য সংরক্ষণের জন্য বন প্রদত্ত জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল।
গ্রীন ইকোনমি বা সবুজ অর্থনীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাই প্রকৃতি ও বনাঞ্চলের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বনজ সম্পদ মূলত প্রায় সব ধরনের পণ্য উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বন নিম্ন কার্বনযুক্ত পণ্য ও খাদ্য উৎপাদনে সহায়তা করে। এটি প্রতিবেশীয় অবকাঠামো হিসেবে ভূমিকা পালন করে, যা বিভিন্ন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ ও আপদ থেকে মানুষকে রক্ষা করে, অভিযোজনের কৌশল প্রদান করে। এছাড়া, বন একদিকে যেমন পর্যটন বাণিজ্যকে সম্প্রসারণ করে, শক্তি উৎপাদন করে, পানি ব্যবস্থাপনায় মূল নিয়ন্ত্রকের কাজ করে অন্যদিকে বন বিভিন্ন ধরনের সেবা বিশেষ করে খাদ্য, ঔষুধপত্র প্রদান থেকে শুরু করে, শিল্পকারখানায় উৎপাদনসহ দ্বিতীয় প্রজন্মের বায়োফুয়েল উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, প্রকৃতি ও বন খাতে বিশ্বের প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ জড়িত। সবুজ অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং কম কার্বন বা কার্বন নিরপেক্ষ উৎপাদনব্যবস্থা চালু করতে বনের গুরুত্ব ও অবদান দু’টিই অনস্বীকার্য। তবে মানুষের কল্যাণে বনের অবদানের বিষয়টি বিশ্বের প্রচলিত হিসাববিজ্ঞান প্রক্রিয়ায় বিবেচিত বা পর্যালোচিত হয় না বলেই জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ফাও) হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় ১৩ মিলিয়ন হেক্টর বনাঞ্চল ধবংস করা হয়।
স্থায়িত্বশীল বন ব্যবস্থাপনা ও বনাঞ্চল সংরক্ষণে বৈশ্বিক বিনিয়োগ
২০০৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, বনখাতে প্রতিবছর ৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করা হয়। এর মধ্যে মোট বিনিয়োগের ২৮ শতাংশ বনব্যবস্থাপনায় ব্যয় হয় এবং বাকি ৭২ শতাংশ বনভিত্তিক বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন ও বাণিজ্যে ব্যয় করা হয়। গ্রীন ইকোনমি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বনখাতে এই বিনিয়োগ যথেষ্ট নয়! এর মতে, মোট বিনিয়োগের সাথে বছরে অতিরিক্ত আরও ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করা উচিত, যা বনাঞ্চল সৃষ্টি এবং বনাঞ্চল সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যয় করা যাবে। অতিরিক্ত এই অর্থ বিনিয়োগ করা হলে নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি হবে এবং বন সংরক্ষণের হার বৃদ্ধি পাবে, যা আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বনশিল্প খাতে ৬০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া, নতুন বন সৃষ্টি এবং সংরক্ষিত বনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে বিশ্বব্যাপী আরও ১০ মিলিয়ন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র বনভিত্তিক পণ্য উৎপাদন বা বাণিজ্যের দিকে মনোযোগী না হয়ে স্থায়িত্বশীল বনব্যবস্থাপনার বিষয়টির দিকেও সমান দৃষ্টি দিতে হবে। নতুন বন সৃষ্টি বা প্রাকৃতিক বন সংরক্ষণসহ স্থায়িত্বশীল বনব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য কয়েকটি বিষয়ের ওপর জোর দিতে হবে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বিষয়গুলো হলো: বন ও বনজ সম্পদের বহুমাত্রিক ব্যবহার, বনজ সম্পদের স্থায়িত্বশীল ব্যবহার এবং একটি বনজ সম্পদের সাথে আরেকটি বনজ সম্পদের আন্তঃসম্পর্কসহ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর জনগণের নিকটে তথ্য ও জ্ঞান সম্প্রসারণ করতে হবে; বনের স্থায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা, রক্ষা এবং ব্যবহার সম্পর্কে একটি অংশগ্রহণমূলক দর্শন ও সম্মতি গড়ে তোলার জন্য বননির্ভর জনগোষ্ঠী ও নীতিনির্ধারকদের সাথে সংলাপ আয়োজন করতে হবে; বনের স্থায়িত্বশীল ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা এবং বন সংরক্ষণ ও রক্ষার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে এমন নীতিমালা ও গাইডলাইন প্রণয়ন করতে হবে এবং সর্বশেষে স্থায়িত্বশীল বনব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ ও রক্ষার জন্য ব্যক্তি ও সরকারি বিনিয়োগ জোরদারের লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
উপসংহার
বন ও বনজ সম্পদের স্থানীয়, জাতীয় এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বাস্তবসম্মত অবদান রেখে চলেছে। বন ও বনজ সম্পদের স্থায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা ও বহুমাত্রিক ব্যবহার একটি নিম্নকার্বন, উচ্চ প্রবৃদ্ধি, ব্যাপক ও ন্যায়সঙ্গত, অভিযোজনযোগ্য এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ সবুজ অর্থনীতি গড়ে তুলতে সহায়তা করে। বন হচ্ছে নিম্ন কার্বন কাঁচামাল ও শক্তির উৎস, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন করে এবং জনগণের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি আনায়নে বলতে গেলে সব ধরনের সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। আসুন প্রাকৃতিক বনাঞ্চল রক্ষা করি এবং এর স্থায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণে উদ্যোগ নিই।
এই লেখায় ব্যবহৃত সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত UNEP’ র ২০১১ সালের প্রতিবেদন: Forest in a GREEN economy থেকে নেওয়া হয়েছে