সরিষা চাষ
মানিকগঞ্জ থেকে বিমল চন্দ্র রায় :
“সরিষায় ভূত বা সরিষার ভিতরে ভূত” এগুলো প্রবাদ প্রবচন। সরিষার তেল নাকে দিয়ে ঘুমানোর কথা বলে নিশ্চিতে থাকার কথা বলা হয়েছে গল্পে, ছড়ায় বা সর্দিতে নাক বন্ধ হলে সরিষার তেল ব্যবহার করা হয়। বর্তমান করোনা মহামারীতে সরিষা তেলের ব্যবহারও অনেক বেড়েছে। সরিষার তেলে সাথে সাথে সরিষার খৈল বিশেষ উপকারী । জমিতে জৈবসার, পশু খাদ্য, মাছের খাদ্য হিসেবেও ব্যাপক ব্যবহার করা হয়। এক কথায় সরিষা একটি অনন্য কৃষি পণ্য যা মানুষের অসংখ্য কাজে লাগে।
বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতে সরিষা চাষ হয়। মানিকগঞ্জ জেলার বিভিন্ন জমিতে এ বছর ৩৭ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্য মাত্রা অর্জন ৩৬ হাজার হেক্টরের বেশী জমিতে বারি-১৪,বারি-১৭, বারি-৯,টরি-৭ উফসি জাতের সরিষা চাষ হয়েছে। সরিষাগাছ ক্রুশিফেরাস গোত্রের একবর্ষজীবি প্রজাতির উদ্ভিদ। একটি সরিষা গাছের জীবন ধারায় আনুমানিক ২০০টির মতো ফুল ফোটে এবং ১ হাজার শষ্যবীজ তৈরী করতে সক্ষম ।
মানিকগঞ্জের কৃষক একসময় স্থানীয় তিন ধরনের সরিষা চাষ করতো। চৈত্যা সরিষা খেসারী কলই ও মুশরী ডাল চাষের সাথী ফসল হিসেবে বোপন করে এবং চৈত্র মাসে পাকে এবং সংগ্রহ করা হয় তাই এর নাম চৈত্যা সরিষা। এ্ সরিষার দানা লাল ও খুব ছোট হয়। চৈত্যা সরিষা তেলের ঝাঁজ অনেক বেশী,গ্রামীন সংস্কৃতির অংশ কাসুন্দ তৈরীতে ও বিভিন্ ধরনে চাটনি তৈরীতে ব্যবহার করা হয়। সরিষা ইলিশের কথা আমরা যারা জানি, তা রান্না করতে এই সরিষা ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া রান্নায় পাঁচ ফোরনের একটি উপাদান এই সরিষা। ব্যাপকভাবে চাষ হয় দেশীজাতের মাঘি সরিষার, মাঘ মাসে পাকে তাই এই নামকরণ। মাঘি সরিষার তেল রান্নার জন্য ব্যবহার করা হয়। আর এক ধরনের সরিষা স্বেতী সরিষা হলুদ বর্ণের এবং সাইজে বড়,তৈল বেশী হয় তবে সংরক্ষনে এবং স্বাদ অন্যগুলোর চেয়ে কম। গ্রামীন পর্যায়ে তেমন চাষের প্রচলন আগে কম ছিল কিন্তু বর্তমানে সরকারী পর্যায়ে উফসি জাতের বড়দানার হলুদ সরিষার চাষ হচ্ছে এবং বিক্রির দিক দিয়ে বেশী দাম তাই এই সরিষার অনেক চাহিদা।
গ্রামীণ মানুষ গরুর ঘানিতে সরিষা দানা পিষে তৈল তৈরী করতো তা অনেক খাঁটি ছিল। যারা তৈল তৈরীর ব্যবসা করে তাদের কুলু সম্প্রদায় বলে। গ্রামীন প্রবাদ“কুলুর বলদ”। বৈদ্যুতিক তেলকল চালুর পর গ্রামীন পর্যায়ে কাঠের ঘানি বন্ধ হয়েছে বা চল নেই। বর্তমানে নিরাপদ খাদ্য আন্দোলনে ফলে অনেকে কাঠের ঘানির তেলের চাহিদা জানান দিচ্ছে। শীতকালে শিশুদের শরীরে সরিষা তেল মেখে রোদে রাখার কথা বলা হয় এবং গ্রামের অনেকে নদী বা পুকুরে গোছলের আগে সরিষা তেল মাখে।
সুন্দর হলুদ ফুল হতে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করে। মৌসুমী মৌচাষিরা এই মধু সংগ্রহ করে থাকে এবং মধূর চাহিদা পূরন করে। সরিষার উপকারিতা বিষয়ে বিজ্ঞানীরা বলেছেন সরিষা বীজে তেল,আমিষ,আঁশ ও গ্লুকোসিনোলেটস থাকে,যা মানুষের শরীরের জন্য খুবই উপকারী। গ্লুকোসিনোলেটস উপদানটি খাদ্যে গাঁজলা-পড়া,ছাতা-ধরা ও ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি হতে বাঁধা দেয়। সরিষায় থাকা কিছু যৌগিক পদার্থ মানবদেহের রক্তের কোলেস্টেরল ও গ্লুকোজ লেভেল কমায়। এ ছাড়া অন্যান্য বহু ঔষধি গুনাগুন রয়েছে এই ছোট বীজটির অভ্যন্তরে ,যা ক্যানসার প্রতিরোধ করে এবং কার্সিনোজেনিক জিনকে দমন করে টিউমার বৃদ্ধিকে রহিত করে।
বাংলাদেশ ছাড়া ও কানাডা, চীন, ভারত, ফান্স, জার্মানী, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, নেপাল, প্রতিবেশী মায়ানমার সহ আরো অনেকদেশে ব্যাপক সরিষা চাষ হয়। আমাদের দেশে যে পরিমান সরিষা উৎপাদন হয় তা দিয়ে আমাদের তেলের চাহিদার অর্ধেকও জোগান হয় না তাই অন্যান্য ভোজ্য তেলের মতো সরিষা আমদানী করতে হয়। এশিয়ার দেশ সমূহের শীত প্রধান ফসল সরিষা আবার কানাডা সহ শীত প্রধান দেশে গ্রীস্মকালে সরিষা চাষ হয়। কানাডা ও রাশিয়ার সরিষা বেশী আমদানী হয় তবে আমাদের দেশের সরিষার গুনগতমান অন্যদের চেয়ে বেশী বিধায় দেশী বাজারে আমাদের দেশিজাতের সরিষা তেলের ব্যাপক চাহিদা।
বেসরকারী উন্নয়ন গবেষনাধর্মী প্রতিষ্ঠান বারসিক মানিকগঞ্জ জেলার বিভিন্ন গ্রামে প্রান্তিক,ভূমিহীন,ক্ষুদ্র কৃষক ও অন্যান্য গ্রামীন জনগোষ্ঠীর সাথে নিরাপদ খাদ্য ও খাদ্য নিরাপত্তাসহ নানান বিষয়ে জীবন মান উন্নয়নে দীর্ঘদিন যাবত কাজ করে আসছে। সরিষা চাষে কৃষকদের আরও উৎসাহিত করার বিকল্প নেই।
তথ্যসূত্র: জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যসমূহ।