জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাছের পরিচর্যা করেন গাছিরা
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
আমাদের সমাজে যে শ্রেণীর মানুষ গুলো গাছের আগাছা পরিষ্কার করেন, খেজুর অথবা তাল গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে বিভিন্ন আকারের স্বাদের গুর তৈরি করেন তারা গাছি নামে পরিচিত। তারা কোমড়ে মোটা রশি হাসুয়া রাখার বেতের ঝুঁড়ি গাছ কাটার বিভিন্ন আকৃতির দা বা হাসুয়া, বালি রাখার চুঙ্গা নিয়ে বেড়িয়ে পরেন গাছ কাটতে বা মতান্তরে গাছ ঝুঁড়তে। গাছের পরিচর্যায় গাছের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যে মানুষ গুলো নিয়েজিত আছেন কেমন চলছে তাদের দিন কাল জানতে মুখোমুখি হলে বেড়িয়ে আসে তাদের জীবনের করুণ অধ্যায়ের কথা।
“তালগাছ ঝুড়ার (পরিচর্যার) জন্যি দোলবেদী তলায় গাছে উঠিছিল্যাম। একটা গাছ ঝুড়ার পর আরেকটা গাছে উঠি। তালের ডাগুড়ে বস্যা যখন হাস্যা দিয়া অন্য ডাগুড়ে কোপ দেই সাতে সাতে ঘুঘু সাপ ফনা তুলা কামুড় দিবার লাগে।” সে এত বড় সাপ বলে দুহাতে সাপের আকার বোঝানোর চেষ্টা করেন চাটমোহরের জবেরপুর এলাকার আফসার আলীর ছেলে গাছী আব্বাস আলী (৫০)। “হাস্যা দিয়া সাপেক ভয় দেখায়া কোন মতে নিচে নাম্যা চল্যা আসি। কামুর দিলি হয়তো মর্যাই গেলাম নে। লোকটা মেলা দিন গাছ ঝোড়ে না। গাছের চার মুরো জঙলে ভর্তি আছিল। গাছ থেকে নামার পর গাছের মালিক একটা গাছ ঝোড়ার মজুরি দেয়।” এমন প্রতিকূলতার সম্মুখীন কখনো কখনো হতে হয় গাছীদের। তারপরও জীবন জীবিকার জন্য গাছ থেকে পরে অথবা সাপের কামড়ে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও গাছীরা প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকেন গাছের পরিচর্যায়।
আব্বাস আরো বলেন, “আবাদ বসত করার মতো কোন জায়গা জমি নেই। বাপ বাড়ির ভিট্যার দুই শতক আমার নামে না দিয়ে আমার ছাওয়ালের নামে দিছে। সে জাগায় বাড়ি কর্যা আছি। চাটমোহরের বিভিন্ন এলাকায় গাছ ঝোড়ার পাশাপাশি সিরাজগঞ্জের জামতৈল এলাকায় গিয়ে মেস ভাড়া করে থাকি আর গাছ ঝুড়ি। তখন বাড়ির চিন্তা থাকে না। নারিকেল গাছ ৫০ টাকা, খেজুর গাছ ৮০ টাকা ও তালগাছ ১শ’ থেকে ১শ’ ৫০ টাকায় ঝুড়ি।” তিনি আরও বলেন, “সারাদিন কাম করলি ৫ থেকে ৬শ’ টাকা হয়। কিন্তু অনেক সময়ই কাজই পাই না। বর্ষার সময় বৃষ্টির সময় পরায় চার মাস বন্ধ থাকে এ কাম। বউ শিল্পী বাড়িত হাঁস মুরগি, ছাগল পালে। বড় মিয়্যা রূপা চাটমোহর গার্লস হাই স্কুলি নাইনে পড়ে। ছাওয়াল জীবন গায়ের পাইমারী স্কুলি পড়ে। আরাক ছাওয়াল ছোট। ছাওয়াল মিয়্যার পড়ার খরচসহ পাঁচজন মানষির ভরণ পোষণ করি। পানি বাদে সব কেনা। দৈনিক ৩শ’ টেকার মত খরচ। যখন কামাই থাকে না তখন খুব কষ্টে দিনাতিপাত করা লাগে।”
চাটমোহরের বিলচলন ইউনিয়নের বোঁথর গ্রামের আমিরুদ্দিন প্রাং এর ছেলে কেরামত আলী (৪২) পেশায় একজন গাছি। তাল, খেজুর, নারিকেল, দেবদারুসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ঝুঁড়াই তার পেশা। কৃষি কাজের পাশাপাশি গাছ পরিচর্যার কাজ করেন। কখনো কখনো ডাবের ব্যবসা ও করেন। তিন মেয়ে এক ছেলে তার। মাঠাল সম্পত্তি নাই। বাবার দেয়া ৮ শতাংশ জমির উপর বসবাস করছেন। বড় মেয়ে বীনা কে ৩৫ হাজার যৌতুকে পাশর্^বতী থানার চামটা গ্রামে ও দ্বিতীয় মেয়ে সাগরিকাকে ৪০ হাজার টাকা যৌতুকে দিঘইর গ্রামে বিয়ে দিয়েছেন। তৃতীয় মেয়ে শারমিন স্থানীয় ভোকেশনাল স্কুলে ও ছেলে নাজমুল গ্রামেরই একটি সমবায় স্কুলে পড়ে। শারমিন, নাজমুল ও তারা স্বামী স্ত্রী মিলে মোট চার জনের ভরণ পোষণ করতে হয় কেরামত আলীকে। ছেলে মেয়ের স্কুলের পড়া লেখার খরচ, কাপর চোপর নিত্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিষ পত্রাদি সব কিনতে হয় তাকে। তাই কখনো বসে থাকার মতো সময় তার হয়ে ওঠে না। মেয়েদের বিয়ের সময় দুটি বেসরকারী সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। এ ঋণের কিস্তির ভারও বইতে হচ্ছে তাকে। প্রতি সপ্তাহে ২ হাজার ৫শ’ টাকা ঋণের কিস্তি দিতে হয় তাকে।
গাছ ঝোড়ার সময়ের নানা প্রতিকূলতা সম্পর্কে তিনি বলেন, “কয়াকমাস আগে বোঁথর গোরস্থানের কাছে তাল গাছ ঝোড়ার সময় বিষধর সাপের দেখা মেলে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ধারালো হাসুয়া দিয়ে বিষধর সাপটি কেটে ফেলে ফের গাছের ডাল কাটতে শুরু করি। এর পর আরো দুটি বিষ ধর সাপ ফনা তুলে আমাকে কামড়াতে আসে। আমি কোন মতে অতি দ্রুত গাছ বেয়ে নিচে নেমে এসে প্রাণে রক্ষা পাই।” তিনি আরও বলেন, “একই গ্রামের সাজেদুর মাষ্টারের বাড়িত তাল গাছ ঝোড়ার সময় অনেক বিষাক্ত মৌমাছি (ভিমরুল) কামরায় আমাক। সগলে মনে করছিলো মর্যাই যাব। কিন্তু আল্লা আমাক বাচায়া রাখছে। মেলা দিন হাসপাতালে ভর্তি আছিল্যাম। পরে ভাল হয়া যাই। বিপদ আসলিও বস্যা থাকলি তো আর দিন চলবি লয়। তাই এহনো সময় পালিই দড়ি, হাস্যা লিয়া বাড়াই গাছ ঝুঁরব্যার।”
কেবল আব্বাস আলী বা কেরামত আলী নয় অন্যান্য গাছীদেরকেও হয়তো এমন প্রতিকূলতার সন্মূখীন হতে হয়। বৃক্ষ আমাদের পরম বন্ধু হলেও চাটমোহর বা এর আশেপাশের মানুষ নির্বিচারে গাছ কাটছে। বিশেষত খেজুর গাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে। খেজুরের রসের পিঠে পায়েসের স্বাদ অতুলনীয়। কর্তনের ফলে বৃক্ষের সংখ্যা কমে আসায় সরকারি উদ্যোগে প্রতিবছর গাছ লাগানো হলেও গাছির সংখ্যা ক্রমশই কমে আসছে। আমাদের ভূলে গেলে চলবে না পরিচর্যায় গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকে।